সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে ছয় লেনে উন্নীতকরণের কাজ প্রায় দুই বছর আগে শুরু হয়। এই প্রকল্পের সঙ্গে শেরপুর থেকে নাজিরবাজার পর্যন্ত ওসমানীনগর সীমানায় মহাসড়কের প্রায় ২৩ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে।
ওসমানীনগর উপজেলা অংশে শুরু হয় বেশ কয়েকটি সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের কাজ। অবস্থান ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের কারণে কয়েকটি স্থানে সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেলেও প্রকল্পে পরিবর্তন আনা হয়নি। এতে করে সরকারের অর্থ অপচয় এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে মঙ্গলের চেয়ে দুর্ভোগের আশঙ্কা বেশি রয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারনা। ছয় লেন মহাসড়কের কাজ শুরুর সময় এই সড়কে ২৩ কিলোমিটার অংশের বিভিন্ন স্থানে নিষ্কাশিত পানির প্রবাহ ছিল। সড়ক সংলগ্ন বিস্তীর্ণ ফসলি জমি থেকে এই পানির নিষ্কাশন ও প্রবাহ থাকায় তা অব্যাহত রাখার কথা মাথায় রেখে করা হয় প্রকল্প পরিকল্পনা। তাই সেসব স্থানে ছোট ছোট সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। সড়কের এই অংশে অন্তত ২৪টি এমন প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান।
মহাসড়কের ওসমানীনগর অংশের বেশ কয়েকটি স্থান ঘুরে দেখা যায়, আগে নালা হয়ে পানি প্রবাহিত হতো বলে সেখানে সেতু বা কালভার্ট স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল, সম্প্রতি এসব নালার মধ্যে বেশির ভাগ বিলীন হয়ে গেছে। ফসলি জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করায় বদলে গেছে সেখানকার অবস্থা। নালা না থাকলেও পূর্বনির্ধারিত স্থানেই প্রকল্প বাস্তবায়নে অনড় কর্তৃপক্ষ। শেরপুর থেকে নাজিরবাজার পর্যন্ত ওসমানীনগর সীমানায় মহাসড়কের প্রায় ২৩ কিলোমিটার সীমানাশ এ পর্যন্ত ১৪টি ব্রিজ ও কালভার্টের আংশিক কাজ দৃশ্যমান। আগে যেসব জায়গায় সেতু-কালভার্ট ছিল এখনও সেখানেই তা করা হচ্ছে।
উপজেলার দক্ষিণ গোয়ালাবাজারে একটি কালভার্টের আংশিক কাজ করা হয়েছে। এই কালভার্টের এক প্রান্তে রয়েছে সরকারি কৃষি অফিসসহ জনবসতি। অপর প্রান্তে মার্কেট। এর আশপাশে কোথাও কোনো পানির নালা নেই, যেদিক দিয়ে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সক্রিয় রয়েছে। এমন অবস্থাতেও সেখানেই কালভার্ট নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
দয়ামীর ইউনিয়নের মডেল ফিলিং স্টেশনের মাঝখানে নির্মাণাধীন আরও একটি কালভার্টের পূর্ব পাশের সীমানায় রয়েছে বিশাল প্রাচীর। এর আশপাশে পানির কোনো নালা বা প্রবাহ নেই। সেখানেও কালভার্টের কাজ দৃশ্যমান। স্থানীয়রা বলছেন, একসময় এখানে সড়কের এক পাশ থেকে অন্য পাশে পানির প্রবাহ থাকায় কালভার্ট করা হয়। বর্তমানে অনেক স্থানে সেটির প্রয়োজন না থাকলেও চলমান প্রকল্পের আওতায় কালভার্ট নির্মাণের সিদ্ধান্তে অটল সংশ্লিষ্টরা।
কুশিয়ারাসহ বিভিন্ন হাওরের পানি মহাসড়কের পূর্ব দিকে প্রবেশের কারণে বন্যার সময় পানির স্তর অনেক উচুতে থাকলেও পশ্চিম দিকের পানির স্তর নিচে। বিশেষ করে নাটকিলা, কাগজপুরের খাল, নিরাইয়া বিল, বুড়ি নদীর খালসহ বিভিন্ন খালের ওপর নির্মিত সেতু ও কালভার্ট দিয়ে পূর্ব দিকের পানি পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। এসব এলাকার খাল-বিল ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ঠিকমতো নামতে পারছে না। তাতে বন্যার সময় দীর্ঘ হচ্ছে জলাবদ্ধতা সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যেও ভরাট হওয়া স্থানেই নতুন করে সেতু-কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ স্থাপনা হচ্ছে প্রয়োজনের চেয়ে কম উচ্চতায়। এমন অবস্থায় বন্যার সময় ভোগান্তি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে এলাকাবাসী বলছেন।
ওসমানীনগর উপজেলার শেরপুর থেকে নাজিরবাজার অংশ ঘুরে দেখা যায়, এই অংশে ২৪টি সেতু ও কালভার্টের আংশিক কাজ করা হয়েছে। গোয়ালাবাজারের দক্ষিণ গোয়ালাবাজার এলাকায় নির্মিত কালভাটটি কোনো কাজে আসার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তা খালি চোখে দেখেই বলে দেওয়া যায়। দত্তগ্রাম ও ব্রাহ্মণগ্রাম এলাকার নির্মিত দুটি কালভার্টের আশপাশে মানববসতি ও রাস্তাঘাট রয়েছে। প্রথমপাশা এলাকায় সড়কের দুই পাশে দুটি বিল থাকলেও নির্মাণ করা হচ্ছে সরু কালভার্ট। এক সময়ের খরস্রোতা নাটকিলা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার পরেও সেখানকার মাটির গভীরতা যাচাই ছাড়াই নির্মাণ করা হচ্ছে একটি ব্রিজ। বেগমপুর এলাকায় একটি সরু কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। যার আশপাশে পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই।
তাজপুর থেকে দয়ামীর ইউনিয়ন সীমা পর্যন্ত ১৩টি কালভার্ট তৈরির কাজ চলছে। এর মাঝে দয়ামীর ইউনিয়নের সাড়ে ৬ কিলোমিটার সীমানায় রয়েছে ১১টি কালভার্ট। তাজপুরের ছিলমানপুর এলাকায় নির্মিত হচ্ছে একটি। কাশিকাপন এলাকায় ডাবল বক্সক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হলেও এর গভীরতা একেবারেই কম। দয়ামীরের চকবাজার এলাকায় নির্মিত একটি কালভার্টের উভয় পাশেই রয়েছে বাসাবাড়ি ও সীমানাপ্রাচীর। এ ছাড়া দয়ামীর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি কালভার্টের একপাশে কৃষিজমি থাকলেও অন্যপাশে রয়েছে মানুষের বসতঘর, পুকুরসহ অন্যান্য স্থাপনা।
প্রবীন সাংবাদিক ও বিশিষ্ট লেখক গবেষক আব্দুল হাই মশাহিদ বলেন, চলমান প্রকল্পটি অপরিকল্পিত বলে মনে হচ্ছে। এর কারণে সরকারের অর্থ অপচয় হচ্ছে। জনগণের কাজেও আসবে না। পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রকল্প পরিকল্পনা পরিমার্জন করা গেলে ইতিবাচক হতো। প্রকয়াধীন সেতু ও কালভার্ট উঁচু এলাকায় স্থাপন করা হচ্ছে। এতে করে এগুলো যে পানি নিষ্কাশনের কাজে আসবে না তা বলাই যায়।
উপজেলার একাধিক ইউপি চেয়ারম্যানরা বলেন, দৃশ্যমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে সঠিক পরিকল্পনায় কালভার্ট তৈরি হচ্ছে না। অধিকাংশ কালভার্ট কোনো উপকারে আসবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া কালভার্টের যে গভীরতা দেওয়া হচ্ছে তা খুবই কম। বন্যার সময় এলাকাবাসী ভোগান্তিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার উপজেলা পরিষদের সভায় কথা বলেও সাড়া মেলেনি।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের সিলেট অংশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক দেবাশিস রায় বলেন, কালভার্টগুলো পরিকল্পনা করেই তৈরি করা হচ্ছে। যেসব স্থানে এগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলো আগেই নির্ধারিত। জমি অধিগ্রহণ করে পানি নিষ্কাশনের পথ করা হবে। দ্রুততম সময়ে জমি অধিগ্রহণ কাজ সম্পন্ন করা গেলে প্রকল্পের গতি বাড়বে। ২০২৮ সালের মধ্যে মহাসড়কের নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন জানান, প্রকল্পটি তাদের নয়। এ ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক উন্নয়ন প্রজেক্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে ভালো জানেন। পরিকল্পনা পরিবর্তনে প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে মন্তব্য করেননি এই কর্মকর্তা।