ফেনী সীমান্তবর্তী জেলা হিসেবে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতের ত্রিপুরা পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলে প্লাবিত হয়। মুহুরী, ফেনী, কহুয়া এবং সিলোনিয়া নদী বরাবর অবস্থিত গ্রামগুলো প্রতি বছরই পানিতে তলিয়ে যায়। ঘরবাড়ি, ফসল, স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এমনকি প্রধান সড়ক পর্যন্ত পানির নিচে চলে যায়। অথচ প্রতিবছর এসব দুর্যোগ মোকাবেলার নামে নেওয়া হয় নানা বাঁধ নির্মাণ বা সংস্কার প্রকল্প। ২০২৪ সালের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পরও টেকসই বাঁধ নির্মাণের পরিবর্তে তৈরি করা হয় প্রকল্পভিত্তিক লোক দেখানো বাঁধ। প্রশ্ন উঠছে—এই লোক দেখানো প্রকল্পগুলো কি সত্যিই মানুষকে ২০২৫ সালের বন্যা থেকে রক্ষা করতে পেরেছে?
ফেনীর বাস্তব চিত্র
ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও সদর উপজেলা গত ছয় দিন যাবত আবারও গত বছরের মত অতিবৃষ্টি ও ভারতীয় পাহাড়ি পানিতে পূর্ণ প্লাবনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবারও এই উপজেলাগুলোতে কয়েক হাজার মানুষ গৃহহীন হয়। হাজার- হাজার হেক্টরের বেশি জমির ফসল বিনষ্ট হয়।
প্রতি বছরের মত এবারও ফুলগাজীও পরশুরামের প্রায় ৩৬ স্থানে বাঁধ ভেঙে যায়। এসব বাঁধ ভাঙার ঘটনা এতই নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মানুষ আর সরকারি প্রতিশ্রুতি বা প্রকল্প ঘোষণায় আস্থা রাখে না। প্রতিবছর একই গল্প—প্রকল্প পাশ হয়, টেন্ডার হয়, কাজ হয় বর্ষা শুরুর আগেই, আর কিছুদিনের মধ্যেই সেই বাঁধ ভেঙে পড়ে।
প্রকল্পনির্ভরতা একটা পুরনো ব্যর্থ সংস্কৃতি৷ প্রকল্পনির্ভরতা মানে বছরের পর বছর কাগজে উন্নয়ন, বাস্তবে ধ্বংস। এর প্রধান কিছু কারণ হলো:
১. বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত প্রকল্পগুলো মূলত স্বল্পমেয়াদি বাজেটচক্রে আবদ্ধ।
২. কাজ হয় অস্থায়ী সমাধান হিসেবে, টেকসই নির্মাণ উপকরণ ব্যবহৃত হয় না।
৩. প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় জনগণের মতামত ও অভিজ্ঞতা গুরুত্ব পায় না।
৪. দুর্নীতির অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়— যান্ত্রিক তদারকি ও যাচাই থাকে দুর্বল।
৫. পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী, ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম ও দুর্নীতি।
ফলে বাস্তবে ঘটে যা হওয়ার— বর্ষা নামলে বাঁধ ভাঙে, মানুষ ভাসে, আর বছর শেষে হয় ‘নতুন প্রকল্প’ ঘোষণা।
প্রজন্মভিত্তিক টেকসই বাঁধ: কেন জরুরি এখনই?
প্রকৃত টেকসই বাঁধ মানে শুধু একটুখানি মাটি ফেলে বা ইট বসিয়ে কিছুটা পানির গতি রোধ করা নয়। বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ— যেখানে বাঁধ হবে শক্তিশালী, পরিবেশবান্ধব এবং ভবিষ্যৎ-সহনশীল। একটি প্রজন্মভিত্তিক টেকসই বাঁধের জন্য করনীয়:
১. ফেনী বাঁধ উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা (Master Plan) গ্রহণ এবং নদীর গতিপথ ও পানিপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে প্রকৌশল নকশা করা।
২. সীমান্ত পানির উৎস রাষ্ট্রের (ভারত) সঙ্গে পানি প্রবাহ বিষয়ে সমন্বয় বৃদ্ধি।
৩. দুর্নীতিমুক্ত টেন্ডার ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে টেকসই বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা।
৪. জিও ব্যাগ, কংক্রিট ব্লক এবং স্লোপ প্রটেকশন ব্যবহারে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাবহার করা।
৫. বার্ষিক সংস্কারের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ পরিকল্পনা।
৬. স্থানীয় কৃষক, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ ও যুবদের নিয়ে বাঁধ তদারকি কমিটি গঠন
৭. পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সরকার মিলে যৌথ দায়বদ্ধতা তৈরি করা।
প্রকল্প দিয়ে বছর পার করা যায়, কিন্তু ভবিষ্যৎ রক্ষা করা যায় না। ফেনীর মানুষের দুর্ভোগ কমাতে হলে, শুধু বছরে বছরে বাঁধ সংস্কার করে লাভ নেই। চাই প্রজন্মভিত্তিক, বিজ্ঞাননির্ভর, জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক টেকসই বাঁধ ব্যবস্থা।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজিডি) ও পিএইচডি গবেষক