পর্ব ৩
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে তৈরি ভুয়া তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ফেসবুক, টিকটক, এক্স এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে রাজনৈতিক নেতা, সেলিব্রিটি বা সাধারণ মানুষের পরিচয় বিকৃত করা হচ্ছে, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে এবং তরুণ প্রজন্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করছে। এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট শিশু-কিশোর ও কলেজছাত্রদের মধ্যে উদ্বেগ, বিভ্রান্তি ও মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে, পাশাপাশি তাদের সামাজিক আচরণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর কারণে জীবনের ঝুঁকিও বাড়ছে; বিভ্রান্তি, মানসিক চাপ ও সামাজিক অপমানের ভয়ে অনেকেই চরম সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, এমনকি আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
এ বিষয়ে সিলেটের কলেজছাত্রী নুসরাত জামান বলেন-অনেক ভিডিও দেখে প্রথমে মনে হয় সত্যি, পরে বোঝা যায় তা ভুয়া। এখন আমি কোনো তথ্য শেয়ার করার আগে আগে যাচাই করি এবং বন্ধুদেরও বলি, সত্যতা যাচাই না করলে তা ভাইরাল করা ঠিক নয়। যদিও কখনও কখনও এ ধরনের ভিডিও দেখতে মজা লাগে, তবুও এটি আমাদের জন্য বেশ বিরক্তিকর একটি বিষয়, কারণ বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট অনেক সময় মানসিক চাপ ও ভুল ধারণা তৈরি করে।
এ বিষয়ে অভিভাবকদের সাথে কথা বললে লোহারপাড়ার বাসিন্দা শামসুজ্জামান বলেন-এই ধরনের ভুয়া ও বিকৃত তথ্য মানুষের জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। কিছুদিন আগে দেখলাম, বিদেশে তিন বোনকে নিয়ে অশ্লীল ডিপফেক ভিডিও বানানো হয়েছিল। তা দেখে তাদের একমাত্র ভাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, ভুয়া তথ্য শুধু মানসিক চাপই তৈরি করে না, অনেক ক্ষেত্রে পরিবার ধ্বংসের মতো ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে।
এ বিষয়ে সিলেটের এক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদ নেওয়াজ বলেন-ছাত্রছাত্রীরা অনলাইনে প্রচারিত নানা খবর দেখে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে। এই ধরনের ভুয়া তথ্য শুধু তাদের পড়াশোনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না, বরং সামাজিক আচরণেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। শিক্ষক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা, সঠিক ও যাচাই করা তথ্য চেনার কৌশল শেখানো এবং তাদেরকে অনলাইনে নিরাপদ ও দায়িত্বশীলভাবে তথ্য গ্রহণে উৎসাহিত করা।
এ বিষয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম বলেন-এআই-নির্ভর ভুয়া তথ্য এখন ব্যক্তিগত মর্যাদা, মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। বিশেষ করে তরুণ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এটি ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। তারা যখন সত্য-মিথ্যা আলাদা করতে পারে না, তখন মানসিক চাপ, আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক লজ্জা ও অপমানের ভয়ে শিক্ষা, বন্ধুত্ব এমনকি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও ব্যাহত হচ্ছে। প্রযুক্তির সুবিধা নিতে হবে, তবে সত্যতা যাচাই না করলে আমরা সবাই ঝুঁকিতে পড়ব।
এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (ঢাকা)-এর সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জোবায়ের মিয়া বলেন-AI দিয়ে বানানো ছবি এবং ভিডিও তে এখন সোস্যাল মিডিয়া সয়লাব। অনেকে মজা করে এটা করে থাকেন। কেউ ভিউ বাড়ানোর জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করছেন। এটা সাময়িক ভাবে আনন্দ দিলেও বিপত্তি বাঁধে যখন মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করে উদ্দেশ্য মূলক ভাবে প্রতিপক্ষের চরিত্র হননের চেস্টা করা হয়। কোনো সাধারণ মানুষ, সম্মানিত ব্যক্তি কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যে কেউ এটার শিকার হতে পারেন। এতে তার সম্মান হানি হয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড একজন মানুষকে মানসিকভাবে ভেঙে দেয়, আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।
এ বিষয়ে সিলেট শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন-সমাজ যতই আধুনিক হচ্ছে, ততই আমাদের ভাষা, আচরণ ও সহানুভূতির জায়গায় অনাদর বাড়ছে। এখন মানুষের মুখভঙ্গি, ভুল, কিংবা ব্যক্তিগত দুর্বলতাও সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্ট হয়ে যাচ্ছে। কেউ হোঁচট খেলে, কেউ সেটা ভিডিও করে—কেউ ব্যঙ্গ করে, কেউ হাসির ইমোজি ছুড়ে দেয়। অথচ আমরা ভুলে যাই, সেই দৃশ্যের ভেতরে একজন মানুষ আছে
তার আত্মসম্মান আছে, পরিবার আছে, কষ্ট আছে।
এই মানসিক বিকৃতি শুধু সমাজকে অসুস্থ করছে না, আমাদের মানবিকতাকেও ক্ষয় করছে। অন্যের সম্মান নষ্ট করা মানে নিজের চরিত্র ও বিবেককে কলুষিত করা। প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, যদি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা ও নৈতিক বোধ হারিয়ে যায়, তবে সমাজ ক্রমেই নীচে নামবে। সভ্যতার প্রকৃত রূপ তখন হারিয়ে যাবে—থাকবে শুধু আড়ম্বর, কিন্তু থাকবে না কোনো মানবিকতা।
এ বিষয়ে সিলেট এম. এ. জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী বলেন-এটা নিঃসন্দেহে এক ধরনের মানসিক বিকৃতি। এআই বা চ্যাটজিপিটি—যে প্রযুক্তিই হোক না কেন, এগুলোর ইতিবাচক ব্যবহার সমাজের উপকারে আসতে পারে। এগুলো দিয়ে শিক্ষামূলক কনটেন্ট, জনসচেতনতামূলক ভিডিও বা গবেষণায় সহায়তা করা সম্ভব। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, কিছু মানুষ এসব প্রযুক্তিকে অপব্যবহার করে অন্যকে হেয়প্রতিপন্ন করছে, ভুয়া ও অশালীন কনটেন্ট তৈরি করছে, যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করছে।
তিনি আরও বলেন—এই ধরনের কাজ মানুষের মনে ভয়, বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করে, যার ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের চরম ক্ষতি হয়। অনেক সময় ভুক্তভোগীরা সামাজিকভাবে অপমানিত হয়ে চরম হতাশায় পড়েন এবং আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তাই সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে এবং যারা এ ধরনের অপতৎপরতায় জড়িত, তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
এ বিষয়ে সিলেট বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন—এ ধরনের ভুয়া তথ্য সমাজের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। একটি ভুল ধারণা মানুষের বছরের পর বছর গড়ে তোলা আত্মবিশ্বাস ও অর্জন মুহূর্তেই ভেঙে দিতে পারে। অনেকে এই বিভ্রান্তির কারণে দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক সমস্যায় ভুগেন, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং চরম হতাশায় অমানবিক সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেন। তাই যেকোনো তথ্য গ্রহণের আগে তার নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে এবং সচেতনতার মাধ্যমেই এ ধরনের গুজব ও অপপ্রচার রোধ করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণে ব্যবহার না হলে তা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সঠিক তথ্য প্রচার ও গণসচেতনতা বৃদ্ধিই পারে সমাজকে ভুয়া তথ্যের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা করতে।