সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
রাজনীতি

পিআরসহ ৫ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহম্মাদ রেজাউল করীম পির সাহেব চরমোনাই আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, জুলাইতে ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে দেশকে স্থায়ীভাবে স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করতে, রাষ্ট্রের পরতে-পরতে জমা হওয়া ৫৪ বছরের জঞ্জাল দূর করতে, ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে, সর্বত্র জবাবদিহি নিশ্চিত করতে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় ও স্বাধীন করার জন্য মৌলিক সংস্কার করতে এবং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির শুদ্ধতা আনা ও সব নাগরিকের ভোটের অধিকার, সম্মান-মর্যাদা নিশ্চিত করতে। 

অতএব জুলাই পববর্তী বাংলাদেশে ‘সংস্কার-বিচার ও নির্বাচন’ এই ক্রমধারা অনুসরণ করা রক্তের দায় ও অঙ্গিকার। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সংস্কার ও বিচারকে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বাচনকে মূখ্য করে তোলা হয়েছে। যা দেশকে পুরোনো অশুভ বন্দোবস্তে আবার নিপতিত করবে বলে আমরা আশংকা করি। 

সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। 

পির সাহেব চরমোনাই বলেন, দেশের একটি রাজনৈতিক পক্ষের বক্তব্য-বিবৃতি ও আচরন দেখলে মনে হয়, জুলাইয়ের আন্দোলন হয়েছিলো কেবলই ক্ষমতার পালাবদলের জন্য। আদতে বিগত দিনের রাজনীতিতে এটা পরিষ্কার যে, কেবল নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদলের জন্য জুলাইয়ের অভ্যুত্থান হয় নাই।  

যুগপৎ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম বলেন, আমরা যারা জুলাইতে জীবনকে বাজি রেখে সংগ্রাম করেছি, যারা বাচ্চাদের রক্ত ও জীবন উৎসর্গিত হতে দেখেছি, যারা আহতদের রোনাজারি শুনছি, তারা এই পরিস্থিতি মেনে নিতে পারি না। সেই তাগিদ থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে এবং আমরা জুলাইয়ের প্রত্যাশা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি নিয়ে যুথবদ্ধ আন্দোলন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা ইতোমধ্যেই নানা মাধ্যমে সরকারের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে আমাদেরকে রাজপথের কর্মসূচিতে যেতে হচ্ছে। 

জুলাই সনদের বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করে ইসলামী আন্দোলনের আমির বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পরে ১৪ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বর্ধিত মেয়াদও আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এখনো জুলাই সনদ ঘোষণা করা যায় নাই। জুলাই সনদ নিয়ে অনেক বৈঠক হয়েছে কিন্তু আপনারা লক্ষ করলে দেখবেন, ভবিষ্যত স্বৈরতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করার জন্য অপরিহার্য আইনী সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। একটি নির্দিষ্ট মহল থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঁধা এসেছে। ফলে জুলাইয়ের মূল প্রত্যাশা স্বৈরতন্ত্রকে চিরতরে বিলোপের যে চাহিদা তা পূরণে তেমন প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। এমনকি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে কোনো কোনো সংস্কারের প্রস্তাব জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত হলেও সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে এখনই সেটা বাতিলযোগ্য করে রাখা হয়েছে। ফলে জুলাই সনদ কার্যত সংস্কার সম্পর্কিত বিভিন্ন দলের মতামত দলীলে পরিণত হয়েছে। অথচ প্রত্যাশা ছিলো জুলাই সনদ হবে আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণের দিকনির্দেশনা।

নির্বাচনের পরে সংস্কার বাস্তবায়নের বিষয়ে ভিন্নমত জানিয়ে পির সাহেব চরমোনাই বলেন, আমরা ৯০ সালেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যৌথ সংস্কার প্রতিজ্ঞা দেখেছি। নির্বাচনের আগেও বিভিন্ন দল ইশতেহার দেয়। সেগুলোতে সুন্দর সুন্দর বাণী থাকে। কিন্তু তার কোনো আইনি ভিত্তি না থাকায় নির্বাচনের পরে গালভরা সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন আর হয় না। 

তিনি বলেন, জুলাই সনদ ও সংস্কারও কেবল প্রতিশ্রুতিই হয়ে থাকবে, যদি না তার আইনি ভিত্তি নিশ্চিত না করা যায়। আমরা মনে করি, যে কোনো গণঅভ্যুত্থানের সার্বভৌম এখতিয়ার থাকে। সেই ক্ষমতা ও এখতিয়ার বলে জুলাই সনদকে এ আমলেই বাস্তবায়ন করতে হবে এবং তারই ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। কারণ অতীতের অভিজ্ঞতায় নির্বাচনের পরে কেউ এসে এটা বাস্তবায়ন করবে সেই আশা করা যায় না।

অতএব, দ্রুত সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোটের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদকে আইনসম্মত করতে হবে।

ফ্যাসিবাদের বিচার গতি ও বিস্তৃতি নিয়ে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, আওয়ামী লীগ যে মাত্রায় ও পরিমাণে অপরাধ করেছে তা কোনো পথভ্রষ্ট রাজনৈতিক দলের অপকর্ম না। বরং মাফিয়াদের মতো সুসংহত ও সংঘবদ্ধ অপরাধ। ফলে তাদের বিচারটাও সেই বিবেচনায় ও সেই মাত্রায় হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু বিচারের মাত্রা ও গতি দেখে আমরা হতাশা বোধ করছি। নামে মাত্র কয়েকজনকে আটক করে বিচার চলছে। আওয়ামী লীগের মূলহোতারা সবাই দেশের বাইরে বসে নানা রকম চক্রান্ত করেই যাচ্ছে। জেলা ও থানা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতারা এলাকায় ফিরতে শুরু করেছে। 

তার ভাষায়, আওয়ামী লীগের প্রতিহিংসা ও জিঘাংসা কত নির্মম তা কল্পনাও করা যায় না। বর্তমানে বিচারের যে পরিস্থিতি তাতে অভ্যুত্থানের বিপ্লবীদের জীবন ও দেশ হুমকির মুখোমুখি। এমন বাস্তবতায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দাবি করছে, ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম জেলা পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে এবং বাইরে পালিয়ে থাকা অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। পাচারকৃত টাকা উদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচার ও জাপা নিষিদ্ধের বিষয়ে পির সাহেব চরমোনাই বলেন, পতিত ফ্যাসিবাদের দোসরদের অপতৎপরতায় জাতি বিষিয়ে ছিল বিগত ১৫ বছর। এই লজ্জাহীনেরা ফ্যাসিবাদের সব অপকর্মের পক্ষ নিয়েছে এবং ফ্যাসিবাদকে বেপরোয়া হতে সহায়তা করেছে। এর মধ্যে জাতীয় পার্টির ব্যাপারে সবাই অবগত। তারা ফ্যাসিবাদের মন্ত্রীসভায় ছিল। জালিয়াতিপূর্ণ প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে তারা অংশ নিয়ে অবৈধ নির্বাচনগুলোকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এই জাতীয় পার্টি অভ্যুত্থানের পরে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এখন তারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার পাঁয়তারা করছে। 

দেশের একটি রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান জানিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, জাতীয় পার্টিসহ ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং বিচার চলাকালীন তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ, তারা কোনো স্বাধীন রাজনৈতিক দল নয় বরং তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির প্রকাশ্য এজেন্ট।

সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট হয়েছে মর্মে পির সাহেব চরমোনাই বলেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছাড়া নির্বাচন করা যায় না। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি, জনপ্রশাসনের আচরণ ও সন্ত্রাসের যে ভয়াবহতা আমরা লক্ষ্য করছি, তাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে আমরা আশ্বস্ত হতে পারছি না। এখানে মনে রাখা লাগবে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড একটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ও বটে। লন্ডন বৈঠক, এককভাবে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা ইত্যাদি বিষয়ে বর্তমান সরকার একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি যে পক্ষপাত দেখাচ্ছেন তাতে মাঠপ্রশাসন তাদের দিকে ঝুঁকে পড়াই স্বাভাবিক। আমরা বলব, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। জনপ্রশাসনকে সক্রিয় ও নিরপেক্ষ করতে হবে এবং সরকারকে কোনো দলের প্রতি পক্ষপাত দেখানো থেকে সরে আসতে হবে।

পিআর ইস্যুতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের অবস্থান পূণর্ব্যক্ত করে দলটির আমির বলেন, আমরা বারংবার বলছি যে, বিগত ৫৪ বছরে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়েছে সেই পদ্ধতি দেশকে ক্রমান্বয়ে পেছনের দিকে নিয়ে গেছে। দেশের বর্তমান যা কিছু উন্নয়ন তা ব্যক্তিখাতের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের ফল। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাষ্ট্রের ভিত্তি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা নষ্ট করা এবং দুর্নীতি-দুঃশাসনের মাত্রায় প্রতিটি নির্বাচনই দেশকে আগের চেয়ে খারাপ অবস্থায় ফেলেছে। এমন তিক্ত অতীতের বাস্তবতায় পুরোনো বন্দোবস্তে নির্বাচন করার কোনো অর্থ হয় না। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তাই উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। 

তিনি বলনে, পিআরের সুবিধা কি তা আমরা বারংবার আলোচনা করেছি। কিন্তু অশুভ পুরোনো বন্দোবস্তের কায়েমি স্বার্থবাদের কথায় প্রভাবিত হয়ে পিআর নিয়ে সরকার যে আচরণ করছে তা দুঃখজনক। আমরা সরকারের এই আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই এবং পিআর পদ্ধতিতে আগামী নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

যুগপৎ আন্দোলনের দাবিগুলোকে একত্রে উপস্থাপন করে পির সাহেব চরমোনাই বলেন, আমাদের দাবি সুস্পষ্ট। আমরা জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চাই, এর আইনি ভিত্তি চাই। জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতেই আমরা আগামী জাতীয় নির্বাচন চাই। দ্রুততার সাথে ফ্যাসিবাদের বিচার নিশ্চিত দেখতে চাই। ফ্যাসিবাদের দোসরদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন বন্ধ করতে চাই। জাতীয় পার্টিসহ ফ্যাসিবাদের দোসরদের নিষিদ্ধ চাই। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। আমাদের অবস্থান কোনো দলের বিরুদ্ধে না। বরং জুলাই অভ্যুত্থানের রক্ত ও জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের এই অবস্থান।

যুগপৎ আন্দোলন কোনো দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নয় জানিয়ে পির সাহেব চরমোনাই স্পষ্ট করে বলেন, এই পরিস্থিতিতে দেশের ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিনিধিত্বশীল কিছু রাজনৈতিক সংগঠন একত্রিত হয়ে আলাপ আলোচনা করেছি। আমরা সর্বদিক চিন্তা করে এবং জুলাইয়ের রক্তের প্রতি দায়বোধ থেকে সুনির্দিষ্ট এই দাবীগুলো নিয়ে রাজনৈতিকভাবে মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা একই দাবি নিয়ে যুথবদ্ধ কর্মসূচি পালন করবো। যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলবো ইনশাআল্লাহ।

যুগপৎ আন্দোলনের দাবি ও কর্মসূচি সম্পর্কে পির সাহেব চরমোনাই বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা ধারাবহিক কর্মসূচি পালন করবো এবং ক্রমান্বয়ে কর্মসূচি কঠোর থেকে কঠোরতর হবে। 

দাবিগুলো হলো-

১.    জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে। 

২.    নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হতে হবে।

৩.    সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।

৪.    গণহত্যার বিচার দৃশ্যমান হতে হবে।

৫.    বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ভারতীয় তাবেদার ও ফ্যাসিবাদের দোসর জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের 

বিচার করতে হবে এবং বিচার চলাকালীন তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে।

এই দাবি আদায়ের জন্য আমাদের কর্মসূচি - 

১.    ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল। 

২.    ১৯ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ। 

৩.    ২৬ সেপ্টেম্বর সারাদেশে জেলা/উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল।

এই সম্পর্কিত আরো