বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫
বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
আন্তর্জাতিক

সুদানকে ভাগ করে নিল সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী

তৃতীয় বছরে পা দেওয়া সুদানের যুদ্ধ এখন বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটগুলোর একটি। দেশটির সেনাবাহিনী (এসএএফ) ও আধা সামরিক বাহিনী র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে চলমান এ সংঘাতে ইতিমধ্যে ২০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত ও ১ কোটি ৫০ লাখের বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘ ও স্থানীয় সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, দেশটি কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে—একাংশ সেনাদের দখলে, অপরাংশ আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিহাদ মাশামউন এ যুদ্ধকে ‘পাল্টাপাল্টি দখল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনাদোলুকে বলেন, এটা কোনো একতরফা অভিযান নয়, বরং একধরনের দেওয়া–নেওয়া পরিস্থিতি। কয়েক মাস ধরে উভয় পক্ষই পালাক্রমে কিছু জায়গা দখল করছে, আবার হারাচ্ছে।

উদাহরণ হিসেবে তিনি পশ্চিম এল-ওবেইদের উম সুমেইমা শহরের কথা উল্লেখ করেন, যা প্রথমে সেনাদের দখলে ছিল, পরে আরএসএফ দখল নেয় এবং গত সেপ্টেম্বরে আবার সরকার তা পুনর্দখল করে।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সুদানস পোস্ট জানায়, বর্তমানে সুদানের পূর্ব, উত্তর ও মধ্যাঞ্চল সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর মধ্যে খার্তুম, আল-জাজিরা, হোয়াইট নাইল, কাসালা, গেদারেফ, রিভার নাইল, রেড সি ও সেন্নার প্রদেশ অন্তর্ভুক্ত। মাশামউনের হিসাবে, সেনাবাহিনী দেশটির প্রায় ৬০ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে আর আরএসএফ ও তাদের মিত্রদের দখলে ৪০ শতাংশ।

মাশামউন জানান, উত্তর ও পূর্ব সুদান পুরোপুরি সেনাদের হাতে এবং মধ্যাঞ্চল সম্পূর্ণ মুক্ত—সেখানে আরএসএফের কোনো উপস্থিতি নেই। দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে, ব্লু নাইল ও হোয়াইট নাইল এলাকার ৯৫ শতাংশ সেনা নিয়ন্ত্রণে।

এ ছাড়া দারফুরে এল-ফাশেরের উত্তরাংশ এখনো সেনাবাহিনীর অনুগত গোষ্ঠীগুলোর হাতে, যারা ২০২৩ সালে নিরপেক্ষতা ত্যাগ করে যুদ্ধে যোগ দেয়।

মাশামউন বলেন, খার্তুম ও এর সংলগ্ন শহর বাহরি ও উমদুরমান গত মে থেকে পুরোপুরি আরএসএফমুক্ত এবং সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা (সশস্ত্র সংঘাতের অবস্থান ও ঘটনার তথ্য) এসি-এলইডির (ACLED) পূর্ব আফ্রিকা বিশ্লেষক জালালে গেতাচেউ বিরু বলেন, রাজধানী খার্তুমে এখন তুলনামূলক স্থিতিশীলতা এসেছে, তবে পরিস্থিতি এখনো নাজুক। সরকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে স্থানীয় বিমানবন্দরগুলো পুনরায় চালু করার পদক্ষেপ নিচ্ছে।

জালালে গেতাচেউ আরও জানান, ২০২৫ সালের জুন থেকে সুদান–লিবিয়া–মিসরের সীমান্ত আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে। ত্রিভুজ আকৃতির এই অঞ্চলগুলো বাণিজ্য ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তপথ।

গত ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনী উত্তর কোর্দোফানের রাজধানী এল-ওবেইদ আবার দখল করেছে। তবে এল-ফাশের আরএসএফের হাতে যাওয়ার পর পশ্চিম দিক থেকে সেনাদের ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি হতে পারে বলে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা।

দারফুর অঞ্চলে আরএসএফ এখন পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে চারটির নিয়ন্ত্রণে। মাশামউন বলেন, আরএসএফের শক্ত ঘাঁটি পূর্ব দারফুর থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমে চাদ সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত, যার মধ্যে দক্ষিণ ও উত্তর দারফুরের বড় শহরগুলোও রয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো আরএসএফের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও লুটপাটের অভিযোগ এনেছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, ওই অঞ্চলের ৬২ হাজারের বেশি মানুষ পালিয়েছে।

মাশামউন বলেন, ‘দুঃখজনকভাবে আমরা এখন যে দৃশ্য দেখছি, তা হলো বেসামরিক জনগণের ওপর ইচ্ছাকৃত হামলা। আরএসএফ মনে করে, এই জনগোষ্ঠী সেনাদের সমর্থন করে, তাই তাদের সম্মিলিতভাবে শাস্তি দিচ্ছে। তাদের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা নেই। তারা শুধু হত্যা, লুটপাট ও ধ্বংস করতে জানে।’

মাশামউন আরও বলেন, সংঘর্ষ চলাকালে আরএসএফ বিদেশি ভাড়াটে যোদ্ধা ও আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে। শহরটি পতনের আগে তারা দুই শতাধিক হামলা চালায়। এখন যা ঘটছে, তা সম্পূর্ণ দায়মুক্তির ফল।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, কোর্দোফান অঞ্চল এখন সুদানের পরবর্তী বড় যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। উত্তর ও পশ্চিম কোর্দোফান উভয় পক্ষের মধ্যে বিভক্ত আর কৌশলগত কারণে এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নেওয়া উভয়েরই লক্ষ্য।

বিশ্লেষক জালালে গেতাচেউ বলেন, কোর্দোফান এখন আঞ্চলিক দখলযুদ্ধের নতুন ফ্রন্টলাইন।

মাশামউন জানান, সেনারা বর্তমানে বৃহত্তর কোর্দোফান পুনর্দখলের ওপর মনোযোগ দিচ্ছে, এরপর পশ্চিমে দারফুরের দিকে অগ্রসর হবে। সেনাবাহিনীর লক্ষ্য আরএসএফের সরবরাহ লাইন কেটে দেওয়া এবং চাদ সীমান্ত করিডর বন্ধ করা। উত্তর সুদানের মিত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে চাদ সীমান্ত থেকে নতুন সেনা মোতায়েনেরও পরিকল্পনা রয়েছে।

আরএসএফ কোর্দোফান থেকে খার্তুম ও পোর্ট সুদানের দিকে ড্রোন ও আর্টিলারি হামলা চালাচ্ছে বলেও জানান মাশামউন। তিনি বলেন, বারা ও নুহুদ শহর পুনর্দখল করলে এই হামলা বন্ধ করা সম্ভব হবে।

এর আগে অক্টোবরে আরএসএফ দাবি করে, তারা উত্তর কোর্দোফানের বারা শহর দখল করেছে, ফলে ৪ হাজার ৫০০-এর বেশি বাসিন্দা পালিয়ে গেছে এবং সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর পাওয়া গেছে। শহরটি এল-ওবেইদের কাছেই, যা সেনাদের শক্ত ঘাঁটি হলেও ধীরে ধীরে আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে।

উভয় পক্ষ এখন দখল করা এলাকা শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। এদিকে জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, সুদানের অর্ধেক জনগণ (২ কোটি ২৫ লাখের বেশি) প্রয়োজনীয় খাবারের অভাবে ভুগছে। দারফুর, কোর্দোফান ও খার্তুমজুড়ে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে।

মাশামউন বলেন, দেশটি এক ভয়াবহ অচলাবস্থায় আটকে গেছে। আরএসএফের কোনো সুস্পষ্ট কৌশল বা নিয়ন্ত্রণকাঠামো নেই। এখন তাদের মূল কার্যক্রম হচ্ছে, বেসামরিক বাড়িঘর লুট ও মানুষ হত্যা করা।

এই সম্পর্কিত আরো