‘রাজনীতি যদি শিখতে চাও, দিরাই-শাল্লা চলে যাও’—এই প্রবাদের জন্ম দেওয়া সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) সংসদীয় আসন এবার এক নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের মুখোমুখি। দীর্ঘকাল ধরে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনে এবার বিএনপি ও জামায়াত তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে, যেখানে আওয়ামী লীগ অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। স্বাধীনতার পর থেকে জেলা সদরের সাথে সংযোগ সড়কের অভাব এবং গ্রামীণ অবকাঠামোর অনুন্নতি এই অঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের ভোগান্তি।
একসময়ের প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক রেলপথ মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এই আসন থেকে সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ড. জয়া সেনগুপ্তা নৌকা প্রতীকে বিজয়ী হন। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলানোয় এবং 'ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলে' জয়া সেনগুপ্তা আত্মগোপনে চলে গেছেন বলে জানা যায়। এছাড়া, দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় আওয়ামী লীগও ভোটের মাঠ থেকে অনেকটা দূরে। এই সুযোগে বিএনপি ও জামায়াত ভোটের মাঠে একক আধিপত্য বিস্তারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের ৩১ দফা বাস্তবায়ন, জনসংযোগসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির চারজন প্রার্থী জোরেশোরে কাজ করছেন।
আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ফেব্রুয়ারীর প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, এই আসনে বিএনপির তৎপরতা ততই উত্তাপ ছড়াচ্ছে। সাবেক সংসদ সদস্য নাছির উদ্দীন চৌধুরীর উপস্থিতিতে গত ১০ সেপ্টেম্বর দিরাই এবং ১৫ সেপ্টেম্বর শাল্লায় বিশাল জনসভা করেছে বিএনপি। এককথায়, দিরাই-শাল্লা সংসদীয় আসনে ভোটের মাঠ এখন বেশ সরগরম।
জানা যায়, এই আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেতে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন চারজন প্রার্থী। তারা হলেন— বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নাছির উদ্দীন চৌধুরী, জেলা বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তাহির রায়হান চৌধুরী পাবেল, সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি মিফতা উদ্দিন চৌধুরী রুমি এবং যুক্তরাজ্য বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজমল হোসেন চৌধুরী জাবেদ। এছাড়াও, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মনোনীত প্রার্থী কেন্দ্রীয় জমিয়তের যুগ্ম মহাসচিব ও ইউকে জমিয়তের সভাপতি ড. মাওলানা শোয়াইব আহমেদ এবং এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক অনিক রায়ও প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন।
প্রার্থীদের তৎপরতা ও জনসমর্থন:
নাছির উদ্দীন চৌধুরী (বিএনপি): ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন নাছির উদ্দীন চৌধুরী। অভিযোগ রয়েছে, ভোট কারচুপির কারণে তিনি জয়লাভ করতে পারেননি। এর আগে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সাবেক বিচারপতি মিফতা উদ্দিন চৌধুরী রুমি। পরবর্তীতে ওই নির্বাচন ভেঙে যাওয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে জাতীয় পার্টি থেকে এই এলাকার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন নাছির উদ্দীন চৌধুরী। বর্তমানে তিনি কিছুটা অসুস্থ থাকায় ঢাকায় অবস্থান করছেন এবং শিগগিরই বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার কথা রয়েছে। স্থানীয়দের মতে, তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ফিরে এলে দিরাই-শাল্লার জনগণ তার প্রতি আবারও সাড়া দেবে। বিগত সময়ে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং জেলা বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দিরাই-শাল্লার মানুষের নানা সমস্যা ও দুর্যোগে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তার জনসভায় তিনি দিরাই-শাল্লার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন এবং এটিকে তার সর্বশেষ নির্বাচন উল্লেখ করে অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করে দায়মুক্ত হতে চান।
মিফতা উদ্দিন চৌধুরী রুমি (বিএনপি): সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক বিচারপতি মিফতা উদ্দিন চৌধুরী রুমি নিজ এলাকায় অবস্থান করে বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামগঞ্জে জনসংযোগসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, দিরাই-শাল্লা কৃষিনির্ভর একটি জনপদ। বিএনপি যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই কৃষকের উন্নয়নে কাজ করেছে। তিনি ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দিয়ে এলাকার উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার আহ্বান জানান।
অ্যাডভোকেট তাহির রায়হান চৌধুরী পাবেল (বিএনপি): চলতি সময়ে দিরাই-শাল্লার রাজনীতির মাঠে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া ও জনসংযোগ করে মাঠে সবচেয়ে বেশি সময় পার করছেন অ্যাডভোকেট তাহির রায়হান চৌধুরী পাবেল। তার নেতাকর্মীদের দাবি, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রাথমিকভাবে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। এলাকায় নিয়মিত জনসংযোগ করে জনগণকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। ভয়াবহ করোনাভাইরাস মহামারী এবং ২০২২ সালের বন্যায় তিনি এই আসনের মানুষকে ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে এলাকায় সুনাম কুড়িয়েছেন। গত জুলাই মাসের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দলের নেতাকর্মী ও ছাত্র-জনতাকে উদ্বুদ্ধ করাসহ বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছিলেন। তাহির রায়হান চৌধুরী পাবেল 'সবুজ সিলেট'কে বলেন, তিনি বিভিন্ন দুর্যোগময় সময়ে দিরাই-শাল্লার মানুষের পাশে ছিলেন এবং বিগত সকল আন্দোলন-সংগ্রামে নেতাকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি জনগণের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন এবং দেশনায়ক তারেক রহমান ও দল তাকে মনোনয়ন দিলে বিপুল ভোটে জয়লাভ করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
আজমল হোসেন চৌধুরী জাবেদ (যুক্তরাজ্য বিএনপি): বিগত সময়ে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন যুক্তরাজ্য বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজমল হোসেন চৌধুরী জাবেদ। ভয়াল করোনা মহামারী ও বাইশের বন্যায় এই আসনের মানুষকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন তিনি। তিনি 'সবুজ সিলেট'কে জানিয়েছেন, শৈশব থেকেই তিনি জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ। রাজনীতির সুবাদে তিনি দিরাই-শাল্লার মানুষের কাছাকাছি পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন এবং তাদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকায় দুই উপজেলার মানুষ তাকে আপন করে নিয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মানুষের সাথে তার আরও সম্পৃক্ততা বেড়েছে। তিনি মনোনয়নের ব্যাপারে 'গ্রিন সিগন্যাল' পেয়েছেন উল্লেখ করে অবহেলিত দিরাই-শাল্লাবাসীর উন্নয়নে কাজ করে যেতে চান।
মোহাম্মদ শিশির মনির (বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী): ভোটারদের মধ্যে অনেকটা সাড়া জাগিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আলোচিত আইনজীবী ও ছাত্র শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি ইতোমধ্যে এই আসনের শতাধিক গ্রামে জনসংযোগের কাজ করে ফেলেছেন এবং এখনো অনেক গ্রামে যাচ্ছেন। মানুষের নানাবিধ সমস্যার কথা শুনছেন ও সমাধানের অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। তিনি নিজ অর্থায়নে এই আসনের বিভিন্ন গ্রামে মসজিদ, মন্দিরে নগদ অনুদান, গ্রামীণ রাস্তাঘাট নির্মাণ, খেলার মাঠ উন্নয়ন, কয়েকটি বাজারে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষাবৃত্তি চালু, নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা ও ফুটবল খেলার আয়োজনসহ নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে তরুণ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটারদের মধ্যে শিশির মনিরকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শোনা যাচ্ছে। যোগাযোগ করা হলে মোহাম্মদ শিশির মনির 'সবুজ সিলেট'কে বলেন, তিনি রাজনৈতিক হানাহানি, মিথ্যা আশ্বাস, অসম্মান এবং নির্যাতন চান না। তিনি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই দেশটাকে পরিবর্তন করতে চান। হাওর-বেষ্টিত এলাকা দিরাই-শাল্লার প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে গ্রামীণ রাস্তাঘাট উন্নয়ন, নদী ও খাল খনন করা সহ ৪৫ হাজার বেকার যুবকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে শিল্প-কারখানা তৈরির ভাবনা জানান তিনি।
ড. মাওলানা শোয়াইব আহমেদ (জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম): একই আসনে বাংলাদেশ জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম থেকে ড. মাওলানা শোয়াইব আহমেদকে প্রার্থীতা ঘোষণা করা হলেও রাজনীতির মাঠে তাকে তেমন একটা সরগরম দেখা যায়নি। তবে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার কথা জানিয়ে সরকারের দেওয়া নির্বাচনী শিডিউল মোতাবেক এগিয়ে যাচ্ছেন উল্লেখ করে ড. শোয়াইব আহমেদ বলেন, তিনি ২০০১ সালের আগে থেকেই দিরাই-শাল্লার জনগণের পাশে রয়েছেন এবং বিভিন্ন প্রোগ্রাম করেছেন। পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানা অর্গানাইজেশনের সাথে কাজ করছেন।
অনিক রায় (এনসিপি): এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক অনিক রায় জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (এনসিপি) থেকে মনোনয়ন পেয়ে এই আসনে নির্বাচন করার আলোচনা থাকলেও এলাকায় এসে জনসংযোগ বা কোনো নির্বাচনী প্রোগ্রাম করতে দেখা যায়নি তাকে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২ লাখ ৮৪ হাজার ৮৯৮ জন ভোটার নিয়ে এই আসনটি গঠিত। এরমধ্যে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬৪৭ জন পুরুষ এবং ১ লাখ ৪১ হাজার ২৫১ জন নারী ভোটার রয়েছেন।