রোববার বিকেলে আবারও ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠল সিলেট। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের নিকটবর্তী ভারতের আসামে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৯।
সিলেট আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, সোমবার রাত ৮টা ৪৯ মিনিটে সৃষ্ট ভূমিকম্পটির উৎপত্তি সিলেটের কানাইঘাট সীমান্তে। সিলেটের ডাউকি চ্যুতি থেকে এই ভ’মিকম্পের সৃষ্টি। গত কয়েক বছরে এই চ্যুতিরেখায় বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হওয়ায় বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে।
আসামের এই ভূমিকম্প সিলেটের জন্য সতর্কবার্তা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখেছি যে বাংলাদেশের ভূমিকম্পের দুটি উৎস আছে। একটি উত্তরের দিকে আছে, আরেকটা হচ্ছে পূর্ব দিকে। উত্তরের দিকটা হলো ডাউকি ফল্ট (ডাউকি চ্যুতি)। আজকে যে ভূমিকম্প হলো, সেই হিমালয়ন মেইন ফ্রন্টাল থ্রাস্ট বেল্টে। সেটা আমাদের ভূমিকম্পের আরেকটি উৎসস্থল ডাউকি ফল্টেরই কাছাকাছি।’
তিনি বলেন, সিলেট থেকে কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম পর্যন্ত এই অংশটা খুব বিপজ্জনক। কেন না এখানে হাজার বছরের ওপরে বড় ভূমিকম্প হয়নি। অর্থাৎ যে শক্তিটা জমা হয়ে রয়েছে বা ক্রমাগত জমা হচ্ছে, গত এক হাজার বছরেও এটা শক্তিটা ছাড়েনি। এটা যেকোনো সময় বড় আকারের ভূমিকম্পের স্থান হয়ে উঠতে পারে। আমরা গবেষণায় দেখেছি, এখানে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিসম্পন্ন ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়ার মতো শক্তি জমা হয়ে আছে। আর এটি যেকোনো সময় আঘাত হানতে পারে।
এমনিতেই ভূমিকম্পের ডেঞ্জারজোনে অবস্থান সিলেটের। ফরাসি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসার্টিয়াম ১৯৯৮-এর জরিপ অনুযায়ী ‘সিলেট অঞ্চল’ ১০০ বছরের বেশী সময় ধরে সক্রিয় ভূ-কম্পন এলাকা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।
এদিকে, অপরিকল্পিত নগরায়ন, নীতিমালা না মেনে ভবন নির্মাণসহ নানা কারণে বড় ভ’মিকম্প হলে এখানে বড়ধরণের বিপর্যয়েরই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
জানা যায়, বাংলাদেশের সিলেট ও ভারতের আসাম মিলিয়ে ডাউকি চ্যুতি পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় তিন শ কিলোমিটার বিস্তৃত। ১৮৯৭ সালে ‘ডাউকি ফল্টে’ ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। যাতে ভেঙে পড়ে এই অঞ্চলের বেশিরভাগ বহুতল ভবন।
এদিকে, প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে দিনদিন বাড়ছে আকাশছোঁয়া ভবন তৈরির প্রতিযোগিতা। ভরাট হচ্ছে জলাধার। কেটে ফেলা হচ্ছে পাহাড় টিলা। এতে বাড়ছে ভ’মিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কাও।
গবেষকদের মতে, সিলেটের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ভবনই অপরিকল্পিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ। রিখটার স্কেলে সাত বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে অধিকাংশ ভবনই ভেঙ্গে পড়বে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, অপরিকল্পিত বাসাবাড়ি নির্মাণের কারণে সবচেয়ে বেশী ক্ষতির সম্মুখীন হবে নগরীর শাহজালাল উপশহর, আখালিয়া, বাগবাড়ি, মদিনা মাকের্ট প্রভৃতি এলাকা। বাণিজ্যিক ভবন ও ইমারতের পাশাপাশি নগরীতে অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। গবেষণার তথ্য মতে, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বহু বেসরকারী হাসপাতাল রয়েছে যেগুলো ভূমিকম্পের সময় ধসে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। আর এসব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ধসে পড়লে প্রাণহানি আরো বেড়ে যাবে।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ, জাপান ও শ্রীলংকার একটি বিশেষজ্ঞ টিম সিলেট নগরীর ৬ হাজার ভবনের উপর জরিপ চালিয়ে এই গবেষণা রিপোর্ট তৈরি করেন।
এই গবেষণা দলে ছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম।
তিনি বলেন, ভূমিকম্পের দিক থেকে সিলেট মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও তাৎক্ষণিক ক্ষতি-হ্রাস ও উদ্ধার কাজ চালানোর জন্য সিলেটে আধুনিক কোন যন্ত্রপাতি নেই। তিনি ভূমিকম্পের ঝুঁকি মাথায় রেখে এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান।
তিনি বলেন, সিলেটের ৭৪.৪ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পের কথা চিন্তা না করে তৈরি করা হয়েছে। এগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধক ভাবে নির্মান করা হয়নি। ফলে সাত মাত্রার ভূমকম্প হলেই ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ভেঙ্গে পড়তে পারে।
ভূমিকম্প বিষয়ক বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে জানা যায়, ভূমিকম্পের মাত্রা অনুসারে বাংলাদেশ তিনটি ভূ-কম্পন বলয়ে বিভক্ত। এর মধ্যে এক নম্বর বলয়ে রিখটার স্কেলে ৭ থেকে ৯ বা তার অধিক মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। আর এই এক নম্বর বলয়েই সিলেটের অবস্থান। এই বলয়ে আরও রয়েছে ময়মনসিংহ ও রংপুর।
অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেন, ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে ঘনঘন ভূমিকম্পের উৎপত্তি হলে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবে যদি একই জায়গা থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয় তাহলে অব্যশই চিন্তার বিষয়। এরকম ঘনঘন ভূমিকম্প হলে আমাদের একটু সর্তক থাকতে হবে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের বর্তমান আয়তন ৭৯.৫ কিলোমিটার। ২০২১ সালে সীমানা বর্ধিত করার পূর্ব পর্যন্ত আয়তন ছিল ২৬.৫ বর্গকিলোমিটার। পূর্বের আয়তনের তালিকাভূক্ত হোল্ডিংয়ের সংখ্যা প্রায় ৭৪ হাজার। এর মধ্যে দুই থেকে ২১ তলা পর্যন্ত ভবন রয়েছে ৪১ হাজার ৯৯৫টি। সীমানা বাড়ানোর পর ভবনের সংখ্যা আর জরিপ করা হয়নি।
রোববারের আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে সিলেটে ভূমিকম্প অনুভূত হয়।দিবাগত রাত ২টা ৫৫ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে সিলেটে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ভারতের আসাম রাজ্যের মরিগাঁও। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৩।