সুনামগঞ্জের ছাতক পৌরসভায় প্রায় ১৩ কোটি ২৯ লাখ ৮৭ হাজার ২০৭ টাকা ব্যয়ে নির্মিত অডিটোরিয়াম ভবনটি দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কয়েক বছর কেটে গেলেও ভবনটি এখনো ব্যবহার শুরু হয়নি। এতে সরকারি অর্থ অপচয়ের অভিযোগে স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে।
আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন এ অডিটোরিয়ামের নির্মাণকাজ শেষ হয় কয়েক বছর আগে। তবে ব্যবহার না হওয়ায় ভবনটি ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ছে। দেয়ালের রঙ উঠে যাচ্ছে, ফার্নিচার ও সাউন্ড সিস্টেম নেই, আলোকসজ্জা অসম্পূর্ণ। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভবনের কক্ষগুলোতে জমছে ময়লা-আবর্জনা। সামনে জন্মেছে ঝোপঝাড়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী শামছুল ইসলাম বাবুল বলেন, এমন সুন্দর একটি অবকাঠামো পড়ে থাকাটা আমাদের দুর্ভাগ্য। এটি ব্যবহার হলে ব্যবসায়ী সম্মেলন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এমনকি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ সভাও করা যেত।
অডিটোরিয়াম নির্মাণ প্রকল্পের শুরু থেকেই সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবুল কালাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকল্পের মূল ব্যয় দেখানো হয়েছিল ১৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা। পরবর্তীতে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে তা প্রায় ২৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়।
প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মিম ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং’ কিছুদিন কাজ করার পর মেয়র কর্তৃক হটিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, আবুল কালাম নিজেই কাজের তদারকি করে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। তাছাড়া শহরতলীর মাধবপুর এলাকায় ডাম্পিং ইয়ার্ড প্রকল্পেও প্রায় দুই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
অডিটোরিয়ামের কাজ শুরুর তারিখ ছিল ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর এবং শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর। এর পর তিন বছর পার হতে চললেও এখনো কাজ অসম্পূর্ণ ও ভবন হস্তান্তর হয়নি।
পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা শরদিন্দু রায় বলেন, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এখনো ভবন আমাদের কাছে বুঝিয়ে দেয়নি।
পৌর প্রশাসক তারিকুল ইসলামও একই তথ্য দিয়ে বলেন, ঠিকাদার ভবনের কাজ শেষ করতে পারেনি। ফলে অডিটোরিয়াম অযত্নে পড়ে আছে।
অডিটোরিয়ামটি সংস্কৃতি চর্চা, সভা-সেমিনার, সামাজিক অনুষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি ব্যবহার না হওয়ায় স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা হতাশ।
নাট্যকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য জায়গা পাই না। স্কুলের মাঠ বা খোলা জায়গায় অনুষ্ঠান করতে হয়। অথচ কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত অডিটোরিয়াম তালাবদ্ধ পড়ে আছে।
এত টাকা খরচ করেও আমরা কোনো সুফল পাচ্ছি না। ভবনটি ব্যবহৃত না হলে সরকারি অর্থের ভয়াবহ অপচয়ই হবে বলে জানান শিক্ষকরাও।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু অবকাঠামো নির্মাণ করলেই উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। এর কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক উদ্যোগ, ব্যবস্থাপনা কমিটি ও নিয়মিত বাজেটের প্রয়োজন। ছাতক অডিটোরিয়ামের ক্ষেত্রে এসব কোনো পরিকল্পনাই নেওয়া হয়নি।
এটা স্পষ্ট যে, পরিকল্পনা ছাড়া ভবন তৈরি করা হয়েছে। ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের পরও প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি বলে মন্তব্য করেন সামাজিক সংগঠকরা।
আবুল কালাম চৌধুরী টানা তিন মেয়াদে ছাতক পৌরসভার মেয়র ছিলেন। এ সময় তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বাজার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেন বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।
তবে দীর্ঘ সময় দায়িত্বে থেকেও পৌর শহরে চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন হয়নি। রাস্তাঘাটে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ, পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পানি-বিদ্যুৎ, স্যানিটেশন, বিনোদন ও খেলার মাঠের মতো মৌলিক সুবিধাও নিশ্চিত হয়নি।
সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, ১৩ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মিত অডিটোরিয়াম ভবনটি অব্যবহৃত থাকায় সরকারি অর্থের ভয়াবহ অপচয় ঘটছে।
স্থানীয়দের মতে, অবিলম্বে ভবনটি সচল না করলে এ ব্যয় পুরোপুরি অযৌক্তিক হয়ে যাবে।
স্থানীয় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর দাবি, প্রশাসনের দ্রুত উদ্যোগে অডিটোরিয়ামটি সংস্কৃতি চর্চা, শিক্ষামূলক ও সামাজিক কার্যক্রমে ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। না হলে এটি হবে পরিকল্পনাহীন উন্নয়নের আরেকটি ব্যর্থ দৃষ্টান্ত।