সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্বসম্পন্ন শাহআরেফীন টিলায় পাথর লুটের মহোৎসব শুরু হয়েছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা এই লুটপাট বর্তমানে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। প্রভাবশালী সিন্ডিকেট, অসাধু পুলিশ সদস্য ও নামধারী কিছু সাংবাদিকের যোগসাজশে পাহাড় কাটা, পাথর চুরি এবং জমি দখলের ঘটনায় ওই অঞ্চলে চরম নিরাপত্তাহীনতা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতি রাতে পাথরবাহী যানবাহন থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
তথ্যমতে, হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর সফরসঙ্গী অলী হজরত শাহআরেফীন এই টিলায় অবস্থান করেছিলেন। পর্যটন ও ধর্মীয় গুরুত্ব থাকলেও বর্তমানে টিলাটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রভাবশালী সিন্ডিকেট শত শত শ্রমিক, ফেলোডার এবং লিস্টার মেশিন ব্যবহার করে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করছে। এতে টিলার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি আশপাশের কৃষি জমিও হুমকির মুখে পড়েছে।
গত ১৮ ডিসেম্বর চিকাডহর মৌজায় জমি দখলকে কেন্দ্র করে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। জানা যায়, চিকাডহর গ্রামের এস.এ-৮৯নং দাগভুক্ত নিজস্ব রেকর্ডীয় জমি থেকে পাথর উত্তোলনে বাধা দিলে ইকবাল হোসেন ও তার পরিবারের ওপর হামলা চালায় একটি সংবদ্ধ চক্র। আনোয়ার হোসেন আনাইয়ের নেতৃত্বে দেশীয় অস্ত্রসহ চালানো এই হামলায় সায়েদ, করিম, ফিরুজ ও সাজুসহ বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ থানায় মামলা হলেও এলাকায় এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চিকাডহর, নারাইনপুর ও জালিয়ার পার এলাকার বেশ কয়েকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই লুটপাটের মূল হোতা। এই চক্রের উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলেন— মাসুক, আবুল, সাজ্জাদ, বাবুল, বশর, আনাই, গউস, আলাই, আইয়ুব, রহিম ও খালিক। সূত্র মতে, পাথর উত্তোলনের প্রতিটি গর্ত থেকে পুলিশের নাম ভাঙিয়ে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাবেক আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা এখন দল পাল্টে প্রশাসনের নাম ব্যবহার করে এই চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে।
ভোলাগঞ্জ, পাড়ুয়া ও নোয়াগাঁও—এই তিনটি পথে পাথরবাহী ট্রাক্টর থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলা হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, ভোলাগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ আব্দুল্লাহ আল মামুনের নেতৃত্বে টহলের অজুহাতে গাড়ি আটকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হতো। এসআই মামুনের বিরুদ্ধে গত কয়েক মাসে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তুলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাসিন্দারা। বর্তমানে তাকে বদলি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া পাড়ুয়া ও আলুরঘাট এলাকায় ইলিয়াস আলী রাসা, হুমায়ুন, কেরামত, রাজু, লালু, কবির ও জিলানীসহ একটি চক্র প্রতি গাড়ি থেকে ৫০০ টাকা করে চাঁদা তুলছে।
পরিবেশ ও বন বিষয়ক সংগঠন ‘লিগাল ইনিশিয়েটিভ ফর ফরেস্ট অ্যান্ড এনভাইরোমেন্ট’ (লাইফ)-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি এম. আলী এই পরিস্থিতিকে ‘পরিবেশগত গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, "ফেলোডার ও লিস্টার মেশিন ব্যবহারের ফলে মাটির গভীর স্তরে ধস নামছে, যা দীর্ঘমেয়াদী ভূ-প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনবে। প্রশাসনের চরম ব্যর্থতায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
সিলেট জেলা ও দায়রা আদালতের সিনিয়র আইনজীবী ইরশাদুল হক বলেন, জেলা প্রশাসন জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করলেও মাঠ পর্যায়ে এর কোনো প্রতিফলন নেই। শাহআরেফীন টিলায় অবাধ লুটপাট মূলত উপজেলা প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা। এই নির্লিপ্ততার কারণ খতিয়ে দেখা জরুরি।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম খান জানান, পাথর লুটপাট বন্ধে পুলিশ তৎপর রয়েছে এবং ইতোমধ্যে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ রবিন মিয়া জানান, শাহআরেফীন টিলা রক্ষায় প্রশাসন বদ্ধপরিকর। পরিবেশ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং নজরদারি আরও বাড়ানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি শাহআরেফীন টিলার পাথর লুট ঠেকাতে সড়কে লোহার বেষ্টনী বসানো হয়েছিল এবং সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মো. সারওয়ার আলম পরিদর্শনের পর কঠোর নির্দশনা দিয়েছিলেন। তবে বাস্তবে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থামানোই এখন প্রশাসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।