সিলেট অঞ্চলে থ্যালাসেমিয়া বাহকের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। নিঃশব্দে এর বাহকের সংখ্যা বাড়ায় এর প্রভাব পড়ছে আগামী প্রজন্মের ওপর। চিকিৎসকরা বলছেন- পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে শিগগিরই এই অঞ্চল থ্যালাসেমিয়ার হটস্পটে পরিণত হতে পারে।
সর্বশেষ গবেষণা অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। বিশেষ করে চা-বাগান ও সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে এই হার আরও বেশি, প্রায় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেন-দারিদ্র্য,লেখাপড়া না জানা, বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা না করা এবং আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের প্রবণতা থ্যালাসেমিয়া ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। অধিকাংশ বাহক উপসর্গহীন থাকায় বিষয়টি অবহেলা করা হয় এবং ঝুঁকি থেকেই যায়। এর ফল হিসেবে প্রতি বছরই থ্যালাসেমিয়া মেজরে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে।
এ বিষয়ে থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত নগরীর মাণিকপীর রোড এলাকার বাসিন্দা সেলিনা আক্তার বলেন-থ্যালাসেমিয়া এমন একটি রোগ, যা শুধু একজন রোগীর নয়—পুরো পরিবারের জীবন বদলে দেয়। আমাকে মাসে দুই থেকে তিনবার রক্ত নিতে হয়। প্রতিবারই রক্তের জন্য উদ্বেগে থাকতে হয়, আর চিকিৎসা ব্যয় সামলানোও আমাদের মতো সাধারণ পরিবারের জন্য খুব কঠিন। রোগটি সম্পর্কে আগে জানলে হয়তো আমরা আরও সচেতন হতে পারতাম। আমি চাই—আর কোনো পরিবার যেন এই দুর্ভোগে না পড়ে, সবাই বিয়ের আগে স্ক্রিনিং করুক এবং নিজেদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করুক।
সিলেটের চা-বাগান শ্রমিক সম্প্রদায় থ্যালাসেমিয়ার উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সোসাইটির ২০২২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চা-বাগান শ্রমিক পরিবারের প্রায় চারজনের মধ্যে একজন বাহক। দীর্ঘদিন ধরে আত্মীয়তার মধ্যে বিয়ে এবং প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলছে।
বিষয়ে বুরজান চাবাগানের বাসিন্দা কার্তিক নায়েক বলেন-আমার ছেলেকে মাসে মাসে রক্ত দিতে হয়। আমরা গরিব মানুষ, এত নিয়মিত রক্ত জোগাড় করা আর চিকিৎসার খরচ চালানো খুবই কষ্টের। অনেক সময় রক্তের জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে হয়, পাওয়া না গেলে শিশুকে নিয়ে আরও দুশ্চিন্তায় পড়ি। যদি আগেই জানতে পারতাম যে আমরা বাহক, তাহলে হয়তো এই কষ্ট আমাদের সন্তানের ভোগ করতে হতো না। এখন প্রতিটি দিনই আমাদের জন্য একেকটা যুদ্ধের মতো—রক্ত, চিকিৎসা আর খরচের চিন্তায় পুরো পরিবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। আমি চাই, অন্য কোনো পরিবার যেন এই ভুলের কারণে এমন দুর্ভোগে না পড়ে; সবাই যেন সময়মতো পরীক্ষা করায় এবং নিজেদের সন্তানকে এই আজীবন ভোগান্তি থেকে বাঁচাতে পারে।
এ বিষয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী বলেন-থ্যালাসেমিয়া মূলত বংশগত রক্তরোগ। এতে হিমোগ্লোবিন তৈরির প্রক্রিয়ায় ত্রুটি দেখা দেয়, ফলে আক্রান্ত শিশুদের নিয়মিত রক্ত নিতে হয়—না হলে জীবনহানির আশঙ্কা তৈরি হয়। চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় দরিদ্র পরিবারের জন্য এটি বড় মানসিক ও আর্থিক চাপ। আমাদের হাসপাতালে এখন প্রায়ই থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু ভর্তি হচ্ছে, যাদের বড় অংশই গ্রামের এবং চা-বাগান এলাকার। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো—অনেক পরিবার দেরিতে রোগ শনাক্ত করে আসে, তখন জটিলতা আরও বেড়ে যায় এবং শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে সিলেট বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন-থ্যালাসেমিয়া এখন সিলেটে নীরব মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। থ্যালাসেমিয়া কোনো সংক্রামক রোগ নয়, এটি বংশগত আর দুঃখজনক হলো—আমাদের অনেক মানুষই বাহক হলেও তা জানেন না। ফলে অজ্ঞাতসারে ঝুঁকিপূর্ণ বিয়ে হচ্ছে এবং সেই ভুলের বোঝা বহন করে জন্ম নিচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সিলেটে রোগের প্রকোপ তুলনামূলক বেশি হওয়ার একটি বড় কারণ হলো—এ অঞ্চলে নিজেদের মধ্যে বিয়ে হওয়ার প্রচলন, যেখানে দুইজন বাহকের মিলনের ঝুঁকি বেশি থাকে।
আমরা লক্ষ্য করছি, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থ্যালাসেমিয়া রোগীদের বেশিরভাগই গ্রামের এবং প্রান্তিক এলাকার শিশু, যাদের পরিবার আর্থিক ও সামাজিকভাবে অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়ে।
আমাদের সমাজে বিয়ের আগে রক্তপরীক্ষা করা এখনো সংস্কৃতি হয়ে ওঠেনি, তাই প্রতি বছরই নতুন শিশু আক্রান্ত হচ্ছে।
সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. মো. নাসির উদ্দিন বলেন- থ্যালাসেমিয়া সাধারণত দুটি ধরনে হয়ে থাকে—থ্যালাসেমিয়া মাইনর ও থ্যালাসেমিয়া মেজর। অনেক সময় থ্যালাসেমিয়া শরীরে থাকলেও তা সহজে ধরা পড়ে না। এটি রক্তের একটি বংশগত রোগ, যার ফলে ধীরে ধীরে তীব্র রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। থ্যালাসেমিয়া মেজরে আক্রান্ত রোগীদের একপর্যায়ে শরীরে পর্যাপ্ত রক্ত উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং তাদের নিয়মিত রক্ত নিতে হয়।
তিনি আরও বলেন-থ্যালাসেমিয়া মাইনর আক্রান্তরা অনেক সময় স্বাভাবিক জীবনযাপন করলেও অজান্তেই এই রোগের বাহক হিসেবে থেকে যান, যা বিয়ের আগে পরীক্ষা না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে পারে। তাই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি, বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন তিনি।
সিলেটের জনগণকে উদ্দেশ করে চিকিৎসকরা আহ্বান জানিয়েছেন-বিয়ের আগে নিজের ও জীবনসঙ্গীর রক্তপরীক্ষা করুন। বাহক হলে পরামর্শ নিন। এখনই পদক্ষেপ নিলে ভবিষ্যতের প্রজন্মকে এই দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করা সম্ভব।