মোছাঃ আফিয়া বেগম (৩৫)। প্রায় ১৫ বছর আগে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই সংসারের যাবতীয় কাজ সামলাতে হতো তাঁকে। তখন রান্নার জন্য ব্যবহার করা হতো মাটির চুলা। জ্বালানি হিসেবে ছিল গাছের ডাল, শুকনো গোবর ও ধানের কুঁড়া। চুলায় আগুন ধরালেই চারদিকে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ত। চোখ-মুখ জ্বালা করত, শ্বাস নিতে কষ্ট হতো। তবুও কোনো উপায় ছিল না। শ্বশুরবাড়িতে এসব কষ্টের কথা বলার সুযোগও পাননি তিনি।
দীর্ঘ ১৪ বছর পর সেই কষ্টের দিন শেষ হয়েছে আফিয়ার। এখন তিনি বায়োগ্যাসের মাধ্যমে স্বাচ্ছন্দ্যে রান্না-বান্না করছেন। আফিয়ার বাড়ি জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালী ইউনিয়নের বড় মাহমুদপুর গ্রামে। বর্তমানে তিনি জামালগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে রোগীদের জন্য খাবার প্রস্তুতের কাজ করছেন।
শুধু আফিয়া বেগমই নন, একই গ্রামের সিরাজুল ইসলাম, জমিরুল ইসলামসহ উপজেলার প্রায় ২০টি পরিবার বর্তমানে বায়োগ্যাসের সুবিধা ভোগ করছেন।
উপজেলা যুব উন্নয়ন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, অত্যন্ত সাশ্রয়ী ও বহুমুখী সুবিধার কারণে জামালগঞ্জ উপজেলায় খামারি ও কৃষকদের মধ্যে বায়োগ্যাস ইমপ্যাক্ট প্রকল্পের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে মোট ৭টি বায়োগ্যাস ইমপ্যাক্ট প্রকল্প চালু রয়েছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে জ্বালানি ও অর্থ উভয় ক্ষেত্রেই সাশ্রয় হচ্ছে। গবাদিপশুর গোবর দিয়ে পরিবেশবান্ধব বায়োগ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে। গ্যাস উৎপাদনের পর অবশিষ্ট জৈব পদার্থ জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা যাচ্ছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত সার বিক্রি করে আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন সুবিধাভোগীরা।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে ভীমখালী ইউনিয়নের বড় মাহমুদপুর, সদর ইউনিয়নের তেলিয়া শাহাপুর ও জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের সাচনা গ্রাম ঘুরে দেখা যায়—গরুর খামার থেকে ছোট নালার মাধ্যমে গোবর বায়োগ্যাস কূপে প্রবেশ করানো হচ্ছে। সেই কূপ থেকে উৎপাদিত গ্যাস দিয়ে রান্নার কাজ করছেন গৃহিণীরা।
মাহমুদপুর গ্রামে গিয়ে কথা হয় আফিয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, “বায়োগ্যাস থাকায় এখন খুব সহজেই রান্নার কাজ করতে পারছি। এতে আমার জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে এবং আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছি। আমাদের পরিবারে ১৫ জন সদস্য রয়েছে। আগে মাসে দুইটি গ্যাস সিলিন্ডার কিনতে প্রায় তিন হাজার টাকা খরচ হতো। বায়োগ্যাস ব্যবহারের কারণে এখন সেই খরচ আর নেই।” তিনি আরও জানান, উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বায়োগ্যাস ইমপ্যাক্ট প্রকল্পের আওতায় পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে দুই বছরের চুক্তিতে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বায়োগ্যাস স্থাপন করেছেন।
একই গ্রামের জমিরুল ইসলাম জানান, তিনি প্রায় এক বছর ধরে বায়োগ্যাস ব্যবহার করে রান্না-বান্না করছেন। বায়োগ্যাস স্থাপনের জন্য দুটি কূপ নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। চুলা ও পাইপসহ আনুষঙ্গিক খরচ হয়েছে আরও ২০ হাজার টাকা। প্রতিটি কূপে দৈনিক ৬০-৭০ কেজি গোবর দিতে হয়। যুব উন্নয়ন অফিস থেকে দুই বছর মেয়াদে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেন। বায়োগ্যাস উৎপাদনের পর গোবর থেকে তৈরি জৈব সার বিক্রি করে সেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছেন। প্রতি মাসে বিভিন্ন কৃষক ও কারিতাসের নারীরা জৈব ও কেঁচো সার তৈরির জন্য প্রতি কেজি ৮ টাকা দরে সার নিয়ে যান। এতে মাসিক কিস্তির টাকা সহজেই উঠে আসে। তিনি বলেন, “এই বায়োগ্যাসের মাধ্যমে আগামী ৪০ বছর প্রায় বিনা খরচে জ্বালানি ব্যবহার করা যাবে।
জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের সাচনা গ্রামের বায়োগ্যাস ব্যবহারকারী কাকলী আক্তার জানান, তাঁর বড় ভাইয়ের ১২টি গরুর একটি খামার রয়েছে। সেই খামারের গোবর থেকে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। তিনি নিজে গ্যাস ব্যবহার করছেন, পাশাপাশি আত্মীয়স্বজনের ঘরে আরও তিনটি সংযোগ দিয়েছেন। এতে প্রতি মাসে সব মিলিয়ে প্রায় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। পাশাপাশি উৎপাদিত জৈব সার নিজ জমি ও আত্মীয়স্বজনের জমিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
উপজেলা যুব উন্নয়ন কার্যালয় সূত্রে আরও জানা যায়, বায়োগ্যাস ইমপ্যাক্ট প্রকল্পের আওতায় উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ৭টি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় শতাধিক মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। বাড়িতে তিনটি গরু থাকলেই ১০০ সিএফটি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি বায়োগ্যাস কমপ্যাক্ট প্রকল্প স্থাপন করা সম্ভব, যাতে দুটি চুলা জ্বালানো যায়। ৩০০ সিএফটি কমপ্যাক্ট প্রকল্পের মাধ্যমে ছয়টি চুলা জ্বালানো সম্ভব, যা দিয়ে ৮ থেকে ১০টি পরিবারের রান্নার কাজ করা যায়।
উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা শেখ মোঃ আজগর আলী বলেন, “বায়োগ্যাস একটি পরিবেশবান্ধব জ্বালানি। এই উপজেলায় বর্তমানে ৭টি পরিবার বায়োগ্যাস ইমপ্যাক্ট প্রকল্পের আওতায় রয়েছে। প্রাথমিকভাবে কিছু খরচ হলেও একই প্রকল্প দিয়ে প্রায় ৪০ বছর পর্যন্ত জ্বালানি সুবিধা পাওয়া যায়। বায়োগ্যাস ব্যবহারের ফলে জ্বালানি কাঠের ওপর নির্ভরশীলতা কমছে, এতে পরিবেশ ও বন রক্ষার পাশাপাশি প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকছে।” তিনি আরও জানান, এ উপজেলায় বায়োগ্যাস ইমপ্যাক্ট প্রকল্পের আওতায় ১০০ জন নারী-পুরুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে ৭টি পরিবারকে ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে, যা ২৪ কিস্তিতে পরিশোধের চুক্তি রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সকল গবাদিপশু খামারিকে অন্তর্ভুক্ত করে জামালগঞ্জ উপজেলাকে ‘বায়োগ্যাস ভিলেজ’-এ রূপান্তরের কাজ চলমান রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুশফিকীন নূর বলেন, “যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বায়োগ্যাস ইমপ্যাক্ট প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে অনেকেই সফলতা পেয়েছেন। এ উপজেলায় পাইপলাইনের গ্যাস না থাকায় অনেকে এখনো লাকড়ি ও গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করেন। তাই জামালগঞ্জ উপজেলায় বায়োগ্যাস প্রকল্প অত্যন্ত জরুরি। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ ও ঋণ সুবিধার ফলে মানুষ উপকৃত হচ্ছেন এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। পাশাপাশি বিষমুক্ত জৈব সার ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বাড়ছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে।