সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ নির্দেশনায় জানানো হয়েছে যে বিদ্যালয়গুলোতে পঞ্চম শ্রেণির পর আর কোনো ক্লাস পরিচালনা করা যাবে না। সিদ্ধান্তটি কার্যকর হওয়ার পর পঞ্চম শ্রেণি শেষে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে হবে। তবে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি ফি, মাসিক বেতন, ইউনিফর্ম ও যাতায়াতব্যয় অনেক পরিবার সামলাতে না পারায় বড় একটি শিক্ষার্থী দল পড়াশোনা থেকে বাদ পড়তে পারে বলে শিক্ষা কর্মকর্তারা মনে করছেন। নতুন আদেশ অনুযায়ী বিদ্যালয়গুলোতে পঞ্চম শ্রেণির পর আর কোনো ক্লাস চালানো যাবে না। এতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এ সিদ্ধান্তে বিশেষ করে প্রত্যন্ত ও পাহাড়ি এলাকার পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কারণ এসব এলাকায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় দূরে হওয়ায় শিশুদের প্রতিদিন দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে হবে— যা ঝুঁকিপূর্ণ ও মানসিকভাবে ক্লান্তিকর। অনেক অভিভাবক ইতোমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, অতিরিক্ত খরচ ও দূরত্বের কারণে তাদের সন্তানের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন— সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে পরিবহন সুবিধা, বৃত্তি, ইউনিফর্ম সহায়তা এবং নিম্নআয়ের অভিভাবকদের জন্য বিশেষ ভর্তুকি না দিলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার আরও বাড়বে। একই সঙ্গে শিক্ষকরা বলছেন— বহু বছর ধরে চলা আপার প্রাইমারি কার্যক্রম হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসনিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে, যা সময়সাপেক্ষ ও চ্যালেঞ্জিং।
এ বিষয়ে খাসদবীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আলী আসরাফ জানায়—আমি অনেক আশা করেছিলাম যে ষষ্ঠ শ্রেণিতেও এই স্কুলেই পড়তে পারব। ভাবছিলাম, আগের মতোই একই স্কুলে, একই বন্ধুদের সঙ্গে থাকব। কিন্তু এখন তো আর তা হচ্ছে না। সিদ্ধান্তের কারণে আমাদের সবার পথ আলাদা হয়ে যাচ্ছে— একেক বন্ধু একেক স্কুলে চলে যাবে। এটা ভেবে খুব খারাপ লাগছে।
আলী আসরাফের বাবা মো. জয়নাল বলেন—আমি গরিব মানুষ। ভেবেছিলাম ছেলেকে এই স্কুলেই চালিয়ে নিতে পারব। কিন্তু এখন আবার নতুন করে স্কুল বদল, ভর্তি প্রক্রিয়া, ইউনিফর্ম—সবকিছুই নতুন করে করতে হবে। এতে আমাদের ওপর অতিরিক্ত খরচের চাপ পড়েছে। কীভাবে সামলাব, সেটা নিয়েই এখন সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় আছি। তার ওপর নতুন স্কুল দূরে হলে প্রতিদিন ওকে আনা–নেওয়ার জন্য অতিরিক্ত সময় ও খরচ দুই-ই লাগবে। এত ঝামেলা এবং খরচের বোঝা আমাদের মতো নিম্নআয়ের পরিবারের পক্ষে সামলানো খুব কঠিন। সিদ্ধান্তটা যদি আগে থেকে জানানো হতো, তাহলে হয়তো প্রস্তুতি নিতে পারতাম, কিন্তু এখন হঠাৎ সবকিছু বদলে যাওয়ায় আমরা দিশেহারা হয়ে পড়েছি।
আরেক অভিভাবক মোমেনা বেগম বলেন—আমি বাসায় কাজ করে মেয়ের পড়াশোনা চালাই। এই স্কুলটা ঘর থেকে খুব কাছে ছিল, তাই সুবিধা হতো। কিন্তু এখন নতুন স্কুল অনেক দূরে হবে। প্রতিদিন ওকে সেখানে পাঠানো আমার পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না। তাই ভাবছি—মেয়েকে আদৌ পড়াতে পারব কি না।
ওকে যদি দূরের স্কুলে পাঠাই, তাহলে প্রতিদিন ভোরে বের হতে হবে, রাস্তাঘাটের নিরাপত্তা নিয়েও দুশ্চিন্তা আছে। তাছাড়া যাতায়াতের অতিরিক্ত খরচ জোগাড় করাও আমার পক্ষে কঠিন। মেয়েটা খুব মন দিয়ে পড়তে চায়, কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে কি না— তা নিয়েই এখন ভয় লাগছে।
ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন—আমার ভাগ্য ভালো, এবার আমি সপ্তম শ্রেণিতে উঠতে পারছি এবং এই স্কুলেই থাকব। কিন্তু আমার বোনের জন্য খুব খারাপ লাগছে। সে এবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠবে, তাই তাকে অন্য স্কুলে যেতে হবে। এখন আমাদের দুই বোন দুই স্কুলে পড়বে, যা ভেবে দুঃখ হচ্ছে। আমি চাই একসঙ্গে আমাদের পড়াশোনা হোক, যাতে আমরা একে অপরকে সাহায্য করতে পারি। নতুন স্কুলে সে ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারবে কি না, সেটাও আমি নিয়ে চিন্তিত।
এ বিষয়ে খাসদবীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদ নেওয়াজ বলেন—সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার ওপর আমাদের করার কিছুই নেই। আমরা শুধু নির্দেশনা অনুযায়ী কাজই করতে পারি। তবে হঠাৎ এই পরিবর্তনের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক যে বাস্তব সমস্যায় পড়বেন, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিদ্যালয় পরিবর্তনের চাপ, অতিরিক্ত খরচ ও দূরত্ব—সব মিলিয়ে শিশুদের শিক্ষাজীবন কিছুটা অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে। আমরা চাই, এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় অভিভাবকরাও যেন প্রয়োজনীয় সহায়তা পান।
এ বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা উপ-পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম বলেন— প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে আর নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়া হবে না। তবে বর্তমানে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে যারা পড়ছে, তারা আগের নিয়মেই লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, নতুনভাবে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা আগের মতোই নিকটবর্তী বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, যাতে তাদের শিক্ষাজীবনে কোনো ধরনের বিঘ্ন না ঘটে। পাশাপাশি, এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অভিভাবকদের স্পষ্ট ধারণা দিতে সব স্কুলকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে
এ বিষয়ে সিলেট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাখাওয়াত এরশেদ বলেন— শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমরা তাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। তিনি আরও বলেন, এই নীতি পরিবর্তন প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকে শিক্ষাব্যবস্থার ধারাবাহিকতা আরও সুস্পষ্ট করবে এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবনকে সুসংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।