সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে হাওরবেষ্টিত এই দুই উপজেলার রাজনৈতিক অঙ্গন। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও অবকাঠামোগত উন্নয়ন বঞ্চনা, সড়ক যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা, স্বাস্থ্য-শিক্ষা খাতের অনগ্রসরতা এবং হাওর রক্ষা বাঁধের দুর্বলতা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ চরমে। প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষের বসবাস থাকা সত্ত্বেও দিরাই-শাল্লা বছরের পর বছর উন্নয়ন-বঞ্চনার শৃঙ্খলে আবদ্ধ।
এমন প্রেক্ষাপটে এবার নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা।
ঐতিহাসিকভাবে এ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিপক্ষীয় ভোটযুদ্ধই মূল সমীকরণ ছিল। তবে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে না পারায় বিরোধী দলগুলোর মধ্যেই লড়াই আরও জটিল হয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত বিএনপির মনোনয়ন। এ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সাংসদ নাছির উদ্দীন চৌধুরী, জেলা বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা এডভোকেট তাহির রায়হান চৌধুরী পাবেল, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী রুমি, যুক্তরাজ্য বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজমল হোসেন চৌধুরী জাবেদ, যুক্তরাজ্য বিএনপির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার আব্দুল মাজিদ তাহের। মনোনয়ন দৌড়ে শুরু থেকেই এগিয়ে ছিলেন নাছির উদ্দীন চৌধুরী ও তাহির রায়হান চৌধুরী পাবেল।
এরই মধ্যে মাঠজুড়ে দেখা যাচ্ছে নির্ঘুম প্রচারণা। বিশেষ করে পাবেল চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থী এডভোকেট শিশির মনির তৃণমূলে বাড়িয়ে দিয়েছেন জনসংযোগ।
স্থানীয় ব্যবসায়ী সুজিত দাস বলেন, বর্ষায় জলাবদ্ধতা, রাস্তার ভাঙাচোরা অবস্থা, হাসপাতালের সেবা সংকট সবকিছুতেই আমরা কষ্ট পাই। পাবেল চৌধুরী অনেকদিন ধরে মানুষের পাশে আছেন। এলাকায় যেভাবে ঘুরে ঘুরে মানুষের খবর নিচ্ছেন, মনে হয় তিনি প্রার্থী হলে দিরাই-শাল্লার দৃশ্যপট বদলাতে পারবেন।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী এডভোকেট শিশির মনিরও তৃণমূলে সাবলীলভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। পাশাপাশি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রার্থী ড. মাওলানা শোয়াইব আহমদও মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। তবে এ আসনের প্রায় অর্ধেক ভোটারই হিন্দু সম্প্রদায়ের হওয়ায় জামায়াত ও জমিয়ত প্রার্থীদের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। অতীতের নির্বাচনে হিন্দু ভোটের বড় অংশ আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছিল। এবার আওয়ামী লীগ না থাকায় ভোট কোন দিকে যাবে তা নিয়ে আলোচনা থাকলেও, স্থানীয়দের মতে হিন্দু ভোট জামায়াত বা জমিয়তের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা কম যা বিএনপিকে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখছে। এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অনিক রায়কে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা করেছে।
সুনামগঞ্জ-২ আসনের রাজনৈতিক ইতিহাসও বেশ বৈচিত্র্যময়। একসময় এটি ছিল আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের শক্ত ঘাঁটি। পরে নাছির উদ্দীন চৌধুরী লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচিত হয়ে রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টে দেন। তার পর নাছির চৌধুরী বিএনপিতে যোগ দেওয়ার পর এ আসনে নতুন হিসাব তৈরি হয়। সাম্প্রতিক কয়েকটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এগিয়ে থাকলেও বিএনপির ভিত্তি এখানে সবসময়ই ছিল শক্ত।
এবার নিরপেক্ষ ভোটাররাও সমীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। দিরাই পৌরসভার বাসিন্দা নবীন চৌধুরী বলেন, রাস্তা-ঘাট, হাসপাতাল, হাওর রক্ষা বাঁধ-সবক্ষেত্রেই আমরা ভোগান্তিতে আছি। মানুষ এখন পরিবর্তন চায়। জাতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি। সে হিসেবে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হলে দিরাই-শাল্লার দীর্ঘদিনের উন্নয়ন বঞ্চনা কাটতে পারে। আমরা এমন কাউকেই চাই, যে দলের নয় এলাকার উন্নয়নকে গুরুত্ব দেবে।
সব মিলিয়ে সুনামগঞ্জ–২ দিরাই-শাল্লা আসন এবারও হাওরাঞ্চলের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসন হিসেবে সামনে এসেছে। উন্নয়ন বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাস, প্রার্থীদের নিরলস প্রচারণা, হিন্দু ভোটের সমীকরণ এবং বিরোধী দলের বহুমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচনী মাঠ আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ভোটারদের আশা, এবার এমন একজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হোন যিনি সত্যিকার অর্থে দিরাই-শাল্লার অবহেলা ঘোচাতে সক্ষম হবেন।
প্রসঙ্গত, সারাদেশের ২৩৭টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করলেও দিরাই-শাল্লা আসনে এখনো আনুষ্ঠানিক বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেনি।
