শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫
শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
সিলেট বিভাগ

স্মার্টফোনে বন্দি শিশু ও তরুণ প্রজন্ম: সিলেটে বাড়ছে ডিজিটাল আসক্তি ও মানসিক চাপ

পর্ব ১-

রাত জেগে মোবাইলে গেম খেলা, ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢোকা, আর পড়ার ফাঁকে টিকটক–ইউটিউব স্ক্রল—সিলেটের বড় একটি অংশের তরুণ–তরুণীর প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এটি। ডিজিটাল যুগ তথ্যপ্রাপ্তি সহজ করলেও, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ, অস্থিরতা, মনোযোগ ঘাটতি, ক্লান্তি ও হতাশা। স্ক্রিনে অতিরিক্ত ডুবে থাকা তরুণদের ‘ডিজিটাল ডোপামিন’ নির্ভরতায় আসক্ত করে তুলছে, যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক আচরণে প্রভাব ফেলছে।
অনিয়ন্ত্রিত স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে পড়াশোনা ও সৃজনশীল চিন্তা ব্যাহত হচ্ছে, ঘুমের গতি নষ্ট হচ্ছে, কমে যাচ্ছে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে স্বাভাবিক যোগাযোগ। 

এই বিষয়ে নগরীর বাগবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মো. তৌহিদ আহমদ বলেন—আমার ছেলে কৌশিক নবম শ্রেণিতে পড়ে, আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা। কিন্তু বেশির ভাগ সময় সে রুমে দরজা বন্ধ করে মোবাইল নিয়ে বসে থাকে। আমি সারাদিন বাইরে থাকি, তার মা আমাকে প্রায়ই অভিযোগ করে। একদিন আমি নিজেই খেয়াল করলাম—দুই হাত দিয়ে দ্রুত মোবাইল টিপছে, কারও সাথে কথা বলছে। প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে জানতে পারলাম সে ফ্রি ফায়ার নামে একটি গেম খেলছে। এই গেম এখন অসংখ্য তরুণকে নষ্ট করে দিচ্ছে। ছেলেকে নিষেধ করলে রাগ দেখায়, কথা বন্ধ করে দেয়, এমনকি ঠিকমতো খাবারও খায় না। আমি সত্যিই খুব উদ্বিগ্ন, কীভাবে তাকে এ অভ্যাস থেকে সরাবো বুঝতে পারছি না।

আরেক অভিভাবক, বালুচর এলাকার গৃহবধূ ফারজানা বেগম বলেন—আমার ছেলের বয়স ১১ বছর। শুরুতে বলে পড়ার অ্যাসাইনমেন্ট দেখবে, তাই আমি মোবাইল দিই। কিন্তু কিছুক্ষণ পর মোবাইল ফেরত চাইলে সে রাগ করে, হাত থেকে ফোন ছাড়তে চায় না, এমনকি মানসিকভাবে খুব অস্থির হয়ে পড়ে। আগে এমন ছিল না। এখন মনে হয় মোবাইলটা যেন ওর থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এই পরিবর্তন আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে তিনি বলেন-এভাবে চলতে থাকলে ওর পড়াশোনা, আচার–আচরণ আর ভবিষ্যৎ কী হবে ভাবতে পারি না।

সিলেট নগরীর বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, শিক্ষার্থীদের মনোযোগে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে।

এ বিষয়ে খাসদবীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদ নেওয়াজ বলেন—ডিজিটাল আসক্তি এবং মানসিক চাপ সত্যিই উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। এখন অনেক ছাত্র–ছাত্রী ক্লাসে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। রাত জেগে মোবাইল ব্যবহারের কারণে সকালে তারা ক্লান্ত থাকে, ফলে পড়ালেখায় আগ্রহ কমে যাচ্ছে এবং শেখার সক্ষমতাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্যও এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মোবাইল দূরে রাখলে শিশুরা অস্থির হয়ে পড়ে, যা তাদের আচরণগত পরিবর্তনের দিকেও ইঙ্গিত দেয়।

এ বিষয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম বলেন- শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম বলেন—ডিজিটাল আসক্তি এখন তরুণ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য একটি প্রকৃত সংকটে পরিণত হয়েছে। অতিরিক্ত মোবাইল ও কম্পিউটার ব্যবহার উদ্বেগ, হতাশা, ঘুমের ব্যাঘাত এবং মনোযোগের ঘাটতি বাড়াচ্ছে। অনেক ছাত্র–ছাত্রী নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছে না, যার ফলে একাকিত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আরও তীব্র হচ্ছে। 

এ বিষয়ে এম. এ. জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজের মনোরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. আহমেদ রিয়াদ চৌধুরী বলেন—ডিজিটাল আসক্তি আজকের তরুণ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। দীর্ঘ সময় মোবাইল, কম্পিউটার বা ট্যাবলেটের স্ক্রিনে থাকলে উদ্বেগ, হতাশা, একঘেয়ে ভাব ও ঘুমের ব্যাঘাত বাড়ছে। তিনি জানান, এ ধরনের আচরণ মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি ও সৃজনশীল চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করছে। 

এ বিষয়ে সিলেট এম. এ. জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী বলেন—বর্তমান সময়ে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে ডিজিটাল আসক্তি উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে গুরুতর প্রভাব পড়ছে। অনেক শিশুর মধ্যে খাওয়াদাওয়ার অনিহা দেখা দিচ্ছে, ফলস্বরূপ পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি বাড়ছে। পাশাপাশি চোখের সমস্যা, কানে ব্যথা বা শ্রবণ সমস্যার মতো শারীরিক জটিলতাও বাড়ছে। সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, বাচ্চারা মাঠে খেলতে যাচ্ছে না, সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা এড়িয়ে চলছে, এমনকি আত্মীয়–স্বজন বাড়িতে এলে সামনেও আসতে চাচ্ছে না।দীর্ঘ সময় মোবাইল বা ট্যাবলেট ব্যবহারের কারণে তাদের ঘুমের স্বাভাবিকতা ভেঙে যাচ্ছে, মনোযোগ কমছে এবং সামাজিক দক্ষতা দুর্বল হয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন-পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তি ব্যবহারে সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে, শিশুদের পর্যাপ্ত ঘুম, খোলা জায়গায় খেলাধুলা এবং মানুষের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ তৈরি করতে হবে। তা না হলে তারা ভার্চুয়াল দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে বড় হবে, যা ভবিষ্যতে মানসিক ও সামাজিক বিকাশে বড় বাধা তৈরি করবে।

এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'র সিলেট বিভাগের সমন্বয়কারী ডা. সুফী মুহাম্মদ খালিদ বলেন-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ডিজিটাল আসক্তির প্রভাব নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা দেখি, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম ঘুমের সমস্যা, মনোযোগের ঘাটতি, উদ্বেগ, একাকিত্ব এবং শারীরিক সক্রিয়তা কমে যাওয়ার মতো সমস্যার সৃষ্টি করছে।
আমাদের দায়িত্ব হলো তরুণদের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ ডিজিটাল জীবনযাপনের চর্চা গড়ে তোলা। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং নীতিনির্ধারকদের সমন্বিত উদ্যোগে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে প্রযুক্তি হবে শেখা ও উন্নতির হাতিয়ার—আসক্তির নয়।

এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (ঢাকা)-এর সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জোবায়ের মিয়া বলেন- অন্যান্য নেশার মতোই ডিজিটাল আসক্ত ব্যক্তিদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, তবে মোবাইল ও ইন্টারনেট আসক্তির ক্ষেত্রে মানসিক ক্ষতি তুলনামূলকভাবে বেশি লক্ষ্য করা যায়। শারীরিক দিক থেকে অনেকের চোখে জ্বালা–জ্বালা ভাব, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হওয়া, ঘাড় ও কাঁধে ব্যথা, কানে সমস্যা এবং ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়। তবে এর মানসিক প্রভাব আরও গভীর—ইন্টারনেট বা ডেটা শেষ হয়ে গেলে অনেকেই বিরক্তি, অস্থিরতা ও উদ্বেগে ভোগে, যেন স্বাভাবিক জীবন থেমে যায়। এমনকি তারা অন্য কাজে মনোযোগ দিতে পারে না, স্বাভাবিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলে এবং সামান্য চাপেও হতাশা বা খিটখিটে মেজাজ প্রদর্শন করে।

এ বিষয়ে সিলেট বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন—শিশু ও কিশোরদের অতিরিক্ত মোবাইল ও কম্পিউটার ব্যবহার এখন গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘসময় স্ক্রিনে ডুবে থাকা মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করে এবং ভবিষ্যতে Brain damage-এর ঝুঁকি বাড়ায়। একই সঙ্গে এটি তাদের আচরণ, মনোযোগ, ঘুম, স্মৃতিশক্তি ও পড়াশোনায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যে বয়সে তারা খেলাধুলা, সমাজচর্চা ও বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, সেই বয়সেই তারা ভার্চুয়াল জগতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। এর ফলে সামাজিক দক্ষতা কমে যাচ্ছে, রাগ, হতাশা ও একাকীত্ব বেড়ে যাচ্ছে। তাই পরিবারের পাশাপাশি স্কুলগুলোকেও সচেতন ভূমিকা নিতে হবে—সুষম স্ক্রিন টাইম, খেলাধুলা, বই পড়া ও মানবিক সম্পর্ক তৈরির অভ্যাস জোরদার করতে হবে, যাতে শিশুরা মানসিকভাবে সুস্থভাবে বড় হতে পারে এবং বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযোগ না হারায়।

এই সম্পর্কিত আরো