মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫
মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
সিলেট বিভাগ

কানাডা পাঠানোর কথা বলে নেপাল নিয়ে জিম্মি: নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন সিলেটের ৩ যুবক

দক্ষিণ সুরমার কুচাই এলাকার হাফিজুর রহমান, মোমিনখলার এম এ মান্না ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলসাইন্দ নাযাত টিল্লার শাহরিয়ার রহমান রনি, এই তিন যুবকের সঙ্গে প্রায় তিন বছর যাবত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেন সিলেটের মিরাবাজারের মিজানুর আমিন। তারা তিনজনই রিজওয়ান নামে এক যুবকের মাধ্যমে মিজানুরের সঙ্গে পরিচিত হন।

দীর্ঘদিন একসঙ্গে আড্ডা, খাওয়াদাওয়া, ঘুরাঘুরি করেন তারা। একসময় রিজওয়ান তাদের জানান মিজানুর বিদেশে লোক পাঠান। তখন এই তিন যুবকের আগ্রহ দেখে মিজানুর তাদের কানাডা যাওয়ার লোভনীয় অফার দেন। মিজান তাদেরকে বলেন নেপাল থেকে হংকং হয়ে সরাসরি ফ্লাইটে তাদের কানাডা পাঠাবেন মাত্র ১২ লাখ টাকায়। নেপাল গিয়ে পাসপোর্টে কানাডার ভিসা লাগানো হবে। কানাডায় পৌঁছার পর দিতে হবে ৫ লাখ টাকা। বাকি ৭ লাখ টাকা কানাডা গিয়ে কাজ করে পরিশোধ করবেন।

মিজানুরের এই লোভনীয় অফারে ফাঁদে পা দেন এই তিন যুবক। এরপর নেপালে তাদের জিম্মি করে কানাডা পৌঁছানোর এডিট করা ছবি দিয়ে তিন যুবকের পরিবারের কাছ থেকে ১৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন মিজানুর।

এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেন মানবপচারের শিকার এই তিন যুবক।

সিলেট সিটি করপোরেশনের মোমিনখলা এলাকার বাসিন্দা এম এ মান্নান (৩৪) জানান, জিন্দাবাজার এলাকায় ভিডিও এডিটিংয়ের ব্যবসা ছিল তার। সেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করা রিজওয়ানের মাধ্যমে মানবপাচারকারী মিজানুর আমিনের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। প্রায় তিন বছরের পরিচয়ে অনেক ভাল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে।

মান্নান বলেন, ‘এত ভালো সম্পর্কের মাঝে যে এভাবে আমাদের বিপদে ফেলবে আমি চিন্তুাও করিনি। মিজানুর আমাদেরকে বলে নেপাল থেকে কানাডার ভিসা করিয়ে দেবে। ১২ লাখ টাকা কানাডা পৌঁছে দেবে। কানাডায় গিয়ে ৫ লাখ টাকা ও বাকি টাকা সেখানে গিয়ে কাজ করে পরিশোধ করার কথা শুনে আমি রাজি হয়ে যাই। নেপাল পৌঁছা পর্যন্ত আমরা তিনজনের কেউ বুঝতে পারিনি যে আমরা প্রতারণার শিকার হয়েছি বা জিম্মি হব। কিন্তু যখন হোটেল থেকে আমাদের পাসপোর্ট নেওয়া হলো তখন আমরা বুঝতে পারি কিছু একটা সমস্যা আছে। পরে আমাদের হোটেল থেকে কানাডার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাবার কথা বলে যখন গাড়িতে তুলে একটা নির্জন এলাকার বাড়িতে নিলো তখন আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারি আমরা প্রতারক চক্রের হাতে পড়ে গেছি। কানাডা যাওয়ার জন্য ব্যবসাও হাতছাড়া করেছি। নেপালে জিম্মি থাকা অবস্থায় আমার পরিবার চার লাখ টাকা দিয়েছে দালাল মিজানুরকে।’

দক্ষিণ সুরমার কুচাই এলাকার হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদেরকে যখন নেপালে নির্জন এলাকার বাড়িতে নিলো তখন আমাদের সঙ্গের শাহরিয়ার রহমান রনি তার মোবাইলে ভিডিও করা শুরু করল। লাইভ লোকেশন বাংলাদেশে মিজানুরের কাছে পাঠায়। ওই বাড়িতে নিয়ে তারা আমাদের হাত-পা বেঁধে মোবাইলগুলো কেড়ে নেয়। অনেক মারধর করে। রনি ভিডিও করায় ওকে বেশি মারে। ওর হাত সিগারেটের আগুন দিয়ে পুড়ে দেয়। এরপর তারা আমাদের বাড়িতে কল দিয়ে বলতে বলে যে আমরা এখন হংকং যাচ্ছি। সেখান থেকে কানাডা যাব। জিম্মিকারীরা ওই রুমে এয়ারপোর্টের মতো সাউন্ড বাজায়। তারপর আমাদের ছবি, ভিডিও এডিট করে বাংলাদেশে মিজানুরের কাছে পাঠায়। মিজানুর সেগুলো আমাদের পরিবারকে দেখায়। তারা বিমানের টাইম মেন্টেইন করে করে আমাদের দিয়ে কল করিয়েছে। সবশেষ আমাদের বন্দুকের মুখে রেখে পরিবারের সঙ্গে কথা বলায়। তখন আমরা বলতে বাধ্য হই যে আমরা কানাডা পৌঁছে গেছি, তোমরা মিজানুরকে টাকা দিয়ে দাও। তখন আমার পরিবার মিজানুরকে ৫ লাখ টাকা দেয়। ধার-কর্জ করে আমার বোনের স্বর্ণ বিক্রি করে এই টাকা দেওয়া হয়। আমরা যখন কল দিয়ে বলি কানাডা পৌঁছে গেছি তখন শাহরিয়ার রহমান রনির পরিবার বুঝে যায় কোনো সমস্যা আছে।’

শাহরিয়ার রহমান রনি বলেন, ‘তারা আমাকে অনেক বেশি মারধর করে। এতে আমি অসুস্থ হয়ে যাই। আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তারা ইনহেলার এনে দেয়। এরপর কিছুটা সুস্থ হলে আমার পরিবারের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতে বলে। তখন ভিডিওকলে আমি কানাডা পৌঁছে গেছি বললেও আমার পরিবারের সন্দেহ হয়। তারা তখন দালাল মিজানুরের বাসায় গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে। সে তখনও কিছু স্বীকার করেনি। বলে ফেরত আনার জন্য ৫ লাখ টাকা লাগবে। আমার পরিবার তাকে টাকা দেয়। পরে আমার বাবা থানায় মামলা করলে পুলিশ মিজানুরকে আটক করে। তখন যারা আমাদের নেপালে জিম্মি করে তারা ফোনে জানতে পারে মিজানুরকে পুলিশ আটক করেছে। এটা জেনে তারা আমাদের নেপাল এয়ারপোর্টের পাশে ফেলে যায়। এরপর আমরা এয়ারপোর্টের ঢুকে ওয়াইফাই কানেক্ট করে বাড়িতে কল দিয়ে জানালে নেপালের একজন পরিচিত আমাদেরে নিয়ে যান ও পরে দেশে পাঠান। দেশে আসার পর ব্র্যাকের পক্ষ থেকে আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করা হয়।

এ ব্যাপারে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর শরিফুল হাসান বলেন, পরিবারগুলো গত ২৬ অক্টোবর পুরো ঘটনা ও বিস্তারিত সব তথ্য জানিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে উদ্ধারের আবেদন করে। এরপর ব্র্যাকের পক্ষ থেকে সিআইডি (অপরাধ তদন্ত বিভাগ) ও নেপালে যোগাযোগ করা হয়। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা হয়। সেদিন রাতেই সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ ও সিআইডির যৌথ অভিযানে স্থানীয় একজন দালালকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের খবর নেপালের পাচারকারীদের কাছে পৌঁছালে তারা ওই দিন রাত ৩টার দিকে কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের পাশে ওই তিনজনকে ছেড়ে দেয়। ৩০ অক্টোবর তারা ঢাকায় ফিরলে ব্র্যাকের ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম তাদের সহায়তা করে। এরপর গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা তাদের জবানবন্দি নেন।

তিনি বলেন, শুধু কানাডা নয়; ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে নেওয়ার কথা বলে নেপালে নিয়ে একইভাবে আটকে রেখে অস্ত্রের মুখে ভয়ভীতি ও নির্যাতন করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। নেপালে যেতে যেহেতু ভিসা লাগে না এবং অন-অ্যারাইভাল ভিসা পাওয়া যায়, তাই পাচারকারীরা প্রথমে নেপালকেই বেছে নেয়। বিশেষ করে ‘কানাডায় পৌঁছানোর পর টাকা পরিশোধ করা যাবে’- এমন প্রলোভনের ফাঁদে পড়ছেন অনেকেই। নেপাল পুলিশ এমন ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে একাধিক বাংলাদেশিকে আটক করলেও এ ধরনের প্রতারণা থেমে নেই। কাজেই সাধারণ বিদেশগামীদের যেমন সচেতন হওয়া জরুরি, তেমনি এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও জানাতে হবে। পাশাপাশি বিদেশে বিপদেপড়া যে কেউ ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে যোগাযোগ করতে পারেন। আন্তর্জাতিক ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে ব্র্যাক তাদের সহায়তা ও পুনর্বাসনে কাজ করবে।

এই সম্পর্কিত আরো