সোমবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৫
সোমবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
সিলেট বিভাগ

ভোটের আগে সিলেট সীমান্ত দিয়ে আসছে অস্ত্র ও বিস্ফোরক

সিলেট বিভাগে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী ছনবাড়ী বাজার এলাকায় অবস্থান নেয় সিলেট ব্যাটালিয়ন (৪৮ বিজিবি)। একপর্যায়ে সন্দেহজনক অস্ত্র চোরাকারবারিরা বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।

পরবর্তী সময়ে ওই এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ছনবাড়ী বাজারের নিকটবর্তী বালুর স্তূপের নিচ থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ২৫০ গ্রাম বিস্ফোরক, ২টি ডেটোনেটর ও ১টি বিদেশি রিভলবার উদ্ধার করা হয়। গত শুক্রবার এমন তথ্য জানান সিলেট ব্যাটালিয়নের (৪৮ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. নাজমুল।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। এই পরিস্থিতিতে সীমান্তবর্তী সিলেটের উপর দিয়ে অবৈধ অস্ত্র আসার শঙ্কা ছিল আগে থেকেই। সেই শঙ্কার আরও ভয়াবহ বাস্তবতাই যেন ৪৮ বিজিবির উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক, ডেটোনেটর ও বিদেশী রিভলভার উদ্ধার। সিলেট বিভাগের আছে চারটি জেলা। এই চার জেলাই (সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার) আছে সীমান্তবর্তী এলাকা। তাই সিলেট বিভাগ অবৈধ চোরাচালানের হটস্পট হিসেবেও পরিচিত। তাই সিলেট সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ রোধ করতে না পারলে আসন্ন নির্বাচন সংঘাতপূর্ণ ও দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

সিলেট ব্যাটালিয়ন (৪৮ বিজিবি) দেওয়া বিদেশী অস্ত্র এবং বিস্ফোরক উদ্ধার পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সিলেটের সীমান্ত এলাকা থেকে ৫টি এয়ারগান, ২টি বিদেশী রিভলবার, ৬ রাউন্ড গুলি, উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ২৫০ গ্রাম বিস্ফোরক এবং ২ টি ডেটোনেটর উদ্ধার করা হয়েছে।

এরমধ্যে গত ৮ এপ্রিল সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী মিনাটিলা এলাকা থেকে ১ টি এয়ারগান, ২৪ আগস্ট গোয়াইনঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী জাফলং চা বাগান সংলগ্ন এলাকার কাটারী নামক স্থান থেকে ৪ টি এয়ারগান, ২৮ আগস্ট সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার সীমান্তবর্তী মাওলারপাড় ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা থেকে ১টি বিদেশী রিভলবার ও ৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়। এবং ৩১ অক্টোবর সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার সীমান্তবর্তী ছনবাড়ী বাজার এলাকা থেকে ১ টি বিদেশী রিভলবার, উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ২৫০ গ্রাম বিস্ফোরক এবং ২ টি ডেটোনেটর উদ্ধার করা হয়। এই সব অস্ত্র ও বিস্ফোরক পরিত্যাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে বিজিবি। এসব ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি।

এছাড়া গত ১২ অক্টোবর জকিগঞ্জ ব্যাটালিয়নের (১৯ বিজিবি) গুয়াবাড়ি বিওপির একটি বিশেষ টহল দল জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত এলাকায় অভিযান চালায়। এ সময় দরবস্ত ভাইটগ্রাম নামক স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি ভারতীয় এয়ারগান, চারটি রামদা ও দুটি ছুরি উদ্ধার করা হয়।

এই পরিস্থিতিতে সিলেট সীমান্ত দিয়ে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক ও অস্ত্র আসা উদ্বেগজনক মনে করছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। এবং দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ গুরুত্ত্বারোপ করার কথাও বলছেন তারা।

এ ব্যাপারে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), সিলেট এর সভাপতি সৈয়দা শিরীন আক্তার বলেন, যেহেতু নির্বাচন আসন্ন তাই সীমান্ত দিয়ে এসব উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক ও অস্ত্র আসা আমাদের জন্য শঙ্কার কারণ। অবশ্যই সামনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এর ব্যবহার বা নির্দিষ্ট কোনো অসৎ উদ্দেশে এসব বিস্ফোরক আনা হচ্ছে। সামনে যারা দেশের ক্ষমতায় যেতে চায় তারা অপর পক্ষকে ঘায়েল করতে এটা ব্যবহার করবে। যেকোনো পক্ষই অরাজকতা করতে পারে এসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক দিয়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এনে এখন জমা করে রাখা হচ্ছে। পরে যখন নির্বাচনী আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হবে তখন ব্যবহার হবে। তখন দেখা যাবে সাধারণ নিরীহ মানুষ মারা যাবে।

এ বিষয়টি সীমান্তরক্ষী বিজিবির টহল বাড়ানো দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের কঠোর অবস্থানে যাওয়া দরকার। পুলিশী টহল আর বাড়ানো দরকার। প্রশাসনের এ ব্যাপারে আরও তৎপর হতে হবে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোর সংশ্লিষ্ট থানাগুলোকে তাদের এলাকাকে অতিরিক্ত পুলিশ নজরদারিতে রাখতে হবে। প্রয়োজন হলে নির্বাচন হওয়ার আগ পর্যন্ত সীমান্ত এলাকাতে স্পেশাল ফোর্স দেওয়া হোক। কোন সীমান্ত দিয়ে অবৈধ জিনিস আসে এটা কিন্তু যারা সংশ্লিষ্ট তারা জানেন। এখন যেহেতু অবৈধ পণ্যের পাশাপাশি অস্ত্রও আছে সেহেতু বিজিবি তাদের চিহ্নিত করুক। সবসময় দেখা যায় সীমান্তে অস্ত্র বিস্ফোরক বা অবৈধ জিনিস পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। কাউকে আটক করা হয় না। এখন অস্ত্র বা বিস্ফোরকতো হেঁটে হেঁটে বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি। কোনো মানুষের মাধ্যমেই আসছে। যারা সীমান্ত রক্ষায় আছেন তাদের কাছেতো চোরাকারবারিদের তালিকাও আছে। তারা এসব তালিকা ধরে অভিযান করে তাদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেওতো পাওয়া যায় কারা এসব অস্ত্র বিস্ফোরক বাংলাদেশে আনছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সিলেট জেলার যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, যেকোনো নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য একটি গোষ্ঠী বরাবরই এসব করে। ভোটার এবং সাধারণ জনগণকে ভয়ভীতি দেখানোই তাদের উদ্দেশ্য। এধরনের কার্যকলাপ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এই নির্বাচনের জন্য সীমান্ত দিয়ে বিস্ফোরক ও অস্ত্র আসা হুমকি সরূপ। এসব শক্তিশালী বিস্ফোরক যদি কোনো নির্বাচনী জনসভায় ফাটানো হয় তাহলে কি পরিমাণ প্রানহানী হবে সেটা ভাবলেও আঁতকে উঠি।

নির্বাচনী বিশৃঙ্খলা তৈরির জন্য এসব বিস্ফোরক ও অস্ত্র দেশে আনা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলে, সবসময় দেখি সীমান্তে অবৈধ জিনিস জব্দ হয়, অস্ত্র উদ্ধার হয় কিন্তু কাউকে আটক করা হয় না। বিজিবিকে কি সীমান্তে রাখা হয়েছে চোরাকারবারিদের ফেলে রাখা অবৈধ জিনিস তুলে আনার জন্য। গতকালতো বিজিবি চোরাকারবারিদের ফেলে যাওয়া কিছু বিস্ফোরক ও অস্ত্র কুঁড়িয়ে আনলো। তার মানে প্রতিনিয়তই সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র বিস্ফোরক প্রবেশ করছে। এটা অবশ্যই দেশের জন্য অশুভ বার্তা। এ বিষয়টি নিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলাবাহীনির নীতিনির্ধারকদের ভাবা উচিত। সীমান্তরক্ষীদের আরও শক্তিশালী ও সক্ষমতা বাড়ানো উচিত। এবং তাদের ঊর্ধ্বতনদের জাবাবদিহীতার আওতায় আনার সময় এখন। তা না হলে সীমান্ত দিয়ে চিনি, তেল, সাবান যেভাবে আসে সেভাবে অস্ত্র আর বিস্ফোরক আসাটাও স্বাভাবিক হয়ে যাবে। পাশাপাশি পুলিশের চেকপোস্ট বাড়াতে হবে। কারণ সীমান্ত অতিক্রম করে এসব বিস্ফোরক ও অস্ত্র উপজেলা, জেলা, সিটির ভিতর দিয়েই নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাবে। সীমান্তে ধরা না পড়লেও যেন পুলিশের চেকপোস্টে ধরা পরে সেরকম পরিকল্পনা করতে হবে। অন্তত সামনের নির্বাচন পর্যন্ত সীমান্ত এলাকাগেুলোর জন্য বিশেষ নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।

এ ব্যাপারে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সুজন সিলেটের সহসভাপতি তাহমিনা ইসলাম বলেন, আমরা বরাবরই শান্তি চাই। আমরা সামনে একটি নির্বাচন প্রত্যাশা করছি। এবং এই নির্বাচন নিয়ে দেশের ব্যাপক মানুষজন মুখিয়ে আছেন। আমাদের দেশ পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে। তাই আগামী নির্বাচনটি আমাদের জন্য অনেক গুরুত্ত্বপূর্ণ। এখন এই নির্বাচনকে সামনে রেখে কোনো অবস্থায় সন্ত্রাসী কাজ বা সমাজ বিধ্বংসী কাজ দেশের শান্তির পথকে হুমকিতে ফেলবে। আমরা যখন স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছি সুন্দর একটি পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছি তখন সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র বা বিস্ফোরক আসা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাদের এ বিষয়ে আরও নজর দেওয়া উচিত। এসবের উৎস, জড়িত কারা সেগুলো খতিয়ে দেখতে হবে এবং কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।

তিনি বলেন, এখনি জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধির মত অবস্থা তৈরি হচ্ছে কি না সেটাও দেখতে হবে। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে একই সূত্রে দেখার সুযোগ যেমন নাই তেমনি এই বিষয়টিকে উড়েয়ে দেওয়াও ঠিক না। এজন্য সংশ্লিষ্ট আইশৃঙ্খলাবাহীনি ও এই সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ যারা আছেন তাদের এই ঘটনাগুলোকে মিলানো দরকার। তাদের ভবিষ্যতের বড় ধরনের কোনো শঙ্কা আমরা আগে থেকেই আঁচ করতে পারবো। কারণ দেশে অস্থিতিশীল হলে এর প্রভাব সাধারণ মানুষের উপর পরবে। অতীতে আমাদের দেশে জঙ্গিবাদের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে এরকম কিছু আমরা আর চাই না। এসবের পুনরাবৃত্তি আর চাই না। সব মানুষের বসবাসের উপযোগী হবে আমাদের দেশ এই প্রত্যাশা নিয়ে আমরা দিন গুনছি।

এই সম্পর্কিত আরো