সিলেট সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) হিসাবরক্ষণ শাখার একজন সাধারণ এমএলএসএস (পিয়ন) সোহাগ আহমেদ (৪০) গত কয়েক বছরে রহস্যজনকভাবে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার এই অভাবনীয় উত্থান সিসিকের অন্দরে এবং বাইরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
দিনমজুর পিতার সংগ্রামী জীবন থেকে শুরু:
সোহাগের পিতা মরহুম হান্নান মিয়া ১৯৯২ সালে চাঁদপুরের পঁচারী গ্রামের দক্ষিণ মতলব থেকে জীবন-জীবিকার সন্ধানে পরিবার নিয়ে সিলেটে আসেন। কাজিরবাজারের হারুন অ্যান্ড সন্সের সুপারির আড়তে দিনমজুরের কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন তিনি। বাবার কষ্ট দেখে বড় ছেলে সোহাগ তৎকালীন সিসিকের স্বাস্থ্য শাখার প্রধান আলবাব চৌধুরীর মাধ্যমে মাত্র ১২০০ টাকা বেতনে বর্জ্য শাখায় কাজ শুরু করেন।
চতুরতার সিঁড়ি বেয়ে হিসাবরক্ষণ শাখায়:
তবে চতুর সোহাগের চোখ ছিল সিসিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসাবরক্ষণে। তৎকালীন হিসাবরক্ষণ শাখার প্রধান মো. মুহিবুর রহমানের অধীনে সুকৌশলে এই শাখায় প্রবেশ করেন তিনি। সিসিকে যোগদানের পর ২০০৭ সালে সোহাগের বাবা পশ্চিম ভাতালিয়ায় একটি ছোট মুদি দোকান দেন এবং এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এই পরিবারকে। একে একে সোহাগ তার ছোট দুই ভাইকেও সিসিকে চাকরি পাইয়ে দেন, যা সিসিকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে রীতিমতো অসম্ভব বলে অনেকে মনে করেন।
আলাদিনের চেরাগ হাতে পিয়ন সোহাগ:
হিসাবরক্ষণ শাখার অসাধু কর্মকর্তাদের বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন সোহাগ এবং তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে বেপরোয়া জীবনযাপন শুরু করেন। ২০১৩ সালে তার চাকরি স্থায়ী হয়। বর্তমানে হিসাবরক্ষণ শাখায় কর্মরত সোহাগের বেতন ২৭-২৮ হাজার টাকা (সোহাগের দাবি ৩০ হাজার)। এই সামান্য বেতনে চাকরি করে কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি কিভাবে কয়েক কোটি টাকার মালিক হলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ঢাকায় তিনটি বাড়ি, চাঁদপুরে সম্পদের পাহাড়:
অভিযোগ রয়েছে, সোহাগের নিয়ন্ত্রণে রাজধানী ঢাকায় রয়েছে তিনটি বিলাসবহুল বাড়ি। পৈতৃক নিবাস চাঁদপুরেও তিনি নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। এর প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে দুদকের একটি মামলায় সিসিকের প্রভাবশালী কর্মকর্তা প্রশাসনিক ও বর্জ্য শাখার প্রধান হানিফুর রহমানসহ অনেকের নাম আসে, যেখানে সোহাগেরও নাম ছিল। এই মামলা থেকে সোহাগ অদৃশ্য খুঁটির জোরে বেঁচে যান বলে জানা গেছে, তবে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান এখনও চলমান রয়েছে।
রহস্যের জট খুলছে ধীরে ধীরে:
সম্প্রতি এসব তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর সোহাগকে ঘিরে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। তার ‘আলাদিনের চেরাগ’ কী, তা জানতে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিসিকের একাধিক কর্মচারী জানান, সিলেটের পশ্চিম শেখঘাটের ১২ নং ওয়ার্ডের নবাব রোডে তার ৭ শতক জায়গার ওপর একতলা ভবন ও একটি টিনশেডের আবাসন রয়েছে। এছাড়াও তার নামে-বেনামে আরও অনেক সম্পদ রয়েছে।
যোগাযোগের চেষ্টা ও অস্বীকার:
সোহাগের ব্যক্তিগত দুটি মোবাইল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও দুটিই বন্ধ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে অনুসন্ধান টিম সিসিকের উদ্দেশ্যে রওনা হলে সাংবাদিকদের দেখেই পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন সোহাগ। পিছু নিলে তিনি থামেন এবং সাংবাদিকদের বসের অফিস রুমে আসতে বলেন। হিসাবরক্ষণ শাখার প্রধান আ.ন.ম মনসুফের সামনে তার অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সোহাগ সবকিছু অস্বীকার করেন। ঢাকা, চাঁদপুর ও সিলেটে তার এত সম্পত্তি কীভাবে অর্জন করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আমার কোনো সম্পত্তি নেই, সব মিথ্যা। আমি আমার বোনের নবাব রোডের নিজস্ব বাড়িতে থাকি।"
উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সমর্থন ও তদবির:
এসময় হিসাবরক্ষণ শাখার প্রধান আ.ন.ম মনসুফ সোহাগের পক্ষ নিয়ে বলেন, "তার বিরুদ্ধে দুদিন পর পর ঢাকা থেকে সাংবাদিকরা তদন্ত করতে আসে। আমরা তদন্ত টিম আসলে যেকোনো উপায়ে বন্ধ করি, পরে আর কিছু হয় না।" তিনি আরও জানান, চাঁদপুরে সম্পত্তি থাকতে পারে, কিন্তু ঢাকায় থাকার কথা নয়, ঢাকায় থাকা তার স্বজনরা এসব মিথ্যাচার করছেন।
তবে সোহাগের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই তাকে বিভিন্ন সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ করতে দেখা যায়। পরবর্তীতে কয়েকজন সাংবাদিক নেতা পরিচয়দানকারী ব্যক্তি প্রতিবেদক টিমের সদস্যদের ফোন দিয়ে তদবির করার চেষ্টা করেন।
সোহাগের এই বিস্ময়কর উত্থান এবং তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো সিসিকের অভ্যন্তরে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। তার এই সম্পদের উৎস এবং এর পেছনে জড়িত অন্যান্যদের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন সিলেটের সচেতন নাগরিকরা।