 
    
    
সচিব হিসাবে নিয়োগ পেয়েও মন্ত্রণালয়ে যোগদান করতে পারেননি সরকারের একাধিক কর্মকর্তা। সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা পদায়নকৃত সচিবদের যোগদানের অনুমতি দেননি। তবে এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও বর্তমান সরকারের সময় একাধিক সচিবকে মন্ত্রণালয়ে যোগদান করতে দেওয়া হয়নি।
এছাড়া সচিবরাও অনেক সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পদায়ন করা কর্মকর্তাকে যোগদানের অনুমতি দেন না। রাজনৈতিক সরকারের সময় এটা চললেও অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সেটা হবে না— এমন ধারণা ছিল সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু এখনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে খারাপ দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখছেন। তারা মনে করেন এতে জনপ্রশাসনে যে অস্থিরতা চলছে সেটা প্রকাশ পাচ্ছে।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এ সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে। এর বেশি তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
তবে সংশ্লিষ্ট এক অতিরিক্ত সচিব যুগান্তরকে বলেন, একজন সচিবকে যে সব মানদণ্ড দেখে পদায়ন করা উচিত, তা দেখেই পদায়ন করা হয়। কিন্তু উপদেষ্টারা কেন তাদের যোগদানের অনুমতি দিচ্ছেন না সে বিষয়ে আমরা কিছুই বলতে পারব না। সচিবরাও অনেক সময় অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবদের মন্ত্রণালয়ে যোগদানের অনুমতি দেন না। কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে— এমন প্রশ্নে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন-এ বিষয়ে তাদের কোনো অনুসন্ধান, গবেষণা ও তদন্ত নেই।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ আগস্ট নতুন সচিব হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুর রহমান তরফদারকে। তিনি যোগ দিতে গেলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন তাকে পরে যোগ দিতে বলেন। দু-একদিন পরে গেলেও উপদেষ্টা তাকে যোগদানের অনুমতি দেননি। এরপর আব্দুর রহমান তরফদারকে বাংলাদেশ কর্ম কমিশন সচিবালয়ের সচিব হিসাবে পদায়ন করা হয়েছে। আবার সরকারি কর্ম কমিশনের সচিব ড. মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন ভূঁইয়াকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসাবে পদায়ন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, একজন অফিসার ৩ মাসে তিনটি পদোন্নতি পেয়েছেন। এমন কর্মকর্তা দিয়ে কি শ্রম মন্ত্রণালয় চলবে? কাকে দিয়ে কাজ হবে সে বিষয়ে মতামত দেওয়ার অধিকার একজন উপদেষ্টার আছে।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার এসব দেখার সময় থাকে না। তিনি ব্যস্ত থাকেন। সেজন্যই আমাদের রাখা হয়েছে এবং আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। ৩ আগস্ট পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে সংযুক্ত অতিরিক্ত সচিব এসএম শাকিল আখতারকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পদায়নের পরই ই-মেইলে যোগদানপত্র দেন শাকিল আখতার। এরপর তিনি সশরীরেও গিয়ে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার তাকে যোগ দিতে দেননি। পরে ২০ আগস্ট বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) আবু তাহের মুহাম্মদ জাবেরকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২১ আগস্ট তিনি ওই পদে যোগদান করেন।
জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বুধবার যুগান্তরকে বলেন, কে আমার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন সে বিষয়ে মতামত বা পছন্দ-অপছন্দ করার অধিকার আমার রয়েছে। তিনি এরচেয়ে বেশি কিছু বলবেন না বলে জানান।
ইতোপূর্বে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. কামাল উদ্দিনকে ২৫ ফেব্রুয়ারি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসাবে পদায়ন করা হয়। উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তাকে যোগদানের অনুমতি দেননি। এর প্রায় ২ মাস পরে মো. কামাল উদ্দিনকে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব হিসাবে পদায়ন করা হয়েছে। জানতে চাইলে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী যুগান্তরকে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নানা কথা বলেন। কিন্তু এ বিষয়ে গণমাধ্যমে কোনো মন্তব্য করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
ইতোপূর্বে গত বছর ৩০ সেপ্টেম্বর সাবেক খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেনকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসাবে পদায়ন করা হলে উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ তাকে যোগদানের অনুমতি দেননি। এর কিছু দিন পর তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় সরকার। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের কার্যক্রম প্রশাসনে খারাপ নজির হয়ে থাকবে। এতে প্রশাসন সম্পর্কে গণমানুষের কাছে বাজে বার্তা যাচ্ছে। প্রশাসনের ভেতরের বিশৃঙ্খলা প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি বলেন, সচিব হিসাবে পদায়নের আগে বিভিন্ন ধরনের যাচাই-বাছাই করা হয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদন নেওয়া হয়। সবশেষে প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন নিয়ে সচিব হিসাবে পদায়ন করা হয়।
ফিরোজ মিয়া বলেন, প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন নেওয়ার পর একজন উপদেষ্টা ওই কর্মকর্তাকে গ্রহণ না করা প্রকারান্তরে প্রধান উপদেষ্টাকে হেয় করা। এটা ঠিক নয়। ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, সচিব নিয়োগের আগে যেন উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে নোট দিয়ে রাখা উচিত। আগে থেকে নোট দেওয়া থাকলে সেক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ভুল করেছে।