বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
ইসলাম

ইসলামে পরকীয়ার শাস্তি কী

মানবসভ্যতার ইতিহাসে কিছু পাপ রয়েছে যা বারবার মানুষের পতনের কারণ হয়েছে। পরকীয়া, ব্যভিচার ও অবৈধ প্রেম তার অন্যতম। 

ইসলাম একে শুধু গুনাহ নয়, বরং বিশ্বাসঘাতকতা ও সভ্যতার জন্য মরণব্যাধি হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবুও আজকের পৃথিবীতে অনেকেই এটিকে আর অপরাধ মনে করে না।

আধুনিকতার নামে, ভালোবাসার ছদ্মবেশে মানুষ সহজেই জড়িয়ে পড়ছে অবৈধ সম্পর্কে। অথচ কুরআন স্পষ্টভাবে সতর্ক করেছে—“তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই এটি অশ্লীল কাজ এবং বিপজ্জনক পথ।” (সূরা আল-ইসরা: ৩২) 

ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ সম্পর্ক কেবল শারীরিক মিলনেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রেমের নামে গোপন যোগাযোগ, ডেটিং, অশ্লীল আলাপ, হাত ধরা, চুম্বন কিংবা অন্তরঙ্গ আচরণ—এসবকেও জিনার ভূমিকা হিসেবে গণ্য করা হয়। 

এ কারণেই শরীয়তে বলা হয়েছে, এগুলোও গুনাহ এবং মানুষকে মূল জিনার দিকে টেনে নিয়ে যায়। তবে এ ধরণের সম্পর্কের জন্য কুরআন ও হাদিসে নির্দিষ্ট হদ্দ শাস্তি নির্ধারিত হয়নি। 

এর বিচার নির্ভর করে রাষ্ট্রপ্রধান বা বিচারকের ওপর, যিনি সমাজের কল্যাণের জন্য অপরাধীকে তাআযীর (সতর্কতামূলক) শাস্তি দিতে পারেন। 

তাআযীর শাস্তি পরিস্থিতি অনুযায়ী সতর্কবার্তা, কারাদণ্ড, জরিমানা বা অন্য কোনো ব্যবস্থা হতে পারে, যা মানুষকে অপরাধ থেকে বিরত রাখবে। 

কিন্তু যখন কেউ প্রকৃত জিনায়—অর্থাৎ অবৈধ যৌন মিলনে—লিপ্ত হয়, তখন এর শাস্তি ইসলামে স্পষ্টভাবে নির্ধারিত। যদি কেউ অবিবাহিত অবস্থায় এ অপরাধ করে, তবে তার শাস্তি হলো প্রকাশ্যে একশত বেত্রাঘাত। 

কুরআনে সূরা আন-নূর (আয়াত ২)-এ এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশ এসেছে। ইসলামের উদ্দেশ্য এখানে কেবল অপরাধীকে দণ্ড দেওয়া নয়, বরং সমাজের সামনে একটি ভীতিকর সতর্কবার্তা হাজির করা, যাতে অন্যরা এ পথে হাঁটতে সাহস না করে। 

অন্যদিকে, যদি কেউ বিবাহিত হয় এবং বৈধ বৈবাহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও জিনায় লিপ্ত হয়, তবে তার অপরাধ বহুগুণে ভয়ংকর। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড—প্রস্তরাঘাত বা রাজম। 

নবী করিম সা.-এর যুগে এই শাস্তি কার্যকর হয়েছে, তবে অত্যন্ত কঠিন শর্তের ভিত্তিতে। অপরাধীকে স্বেচ্ছায় বারবার স্বীকারোক্তি করতে হতো, অথবা চারজন বিশ্বস্ত সাক্ষীকে প্রত্যক্ষদর্শী হতে হতো। 

এ থেকে বোঝা যায় যে, ইসলাম শাস্তি দেওয়ার জন্য উদগ্রীব নয়, বরং এ শাস্তির ঘোষণা দিয়ে মানুষকে ভীত ও সতর্ক করে সীমারেখার ভেতর রাখাই মূল লক্ষ্য। 

ইতিহাসও আমাদের সতর্ক করছে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পেছনে ছিল নৈতিক অবক্ষয় ও পরিবার ভাঙনের অগ্নি। গ্রীস শক্তি হারিয়েছিল অবাধ যৌনাচার ও অনৈতিকতার কারণে। অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ সময়েও অভিজাত সমাজে অবৈধ সম্পর্কের প্রসার তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। পরিবার যখন ধ্বংস হয়, তখন সভ্যতাও পতনের দিকে ধাবিত হয়। আজকের সমাজেও অবস্থা ভিন্ন নয়। 

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পরিবার আদালতের নথি বলছে, বিচ্ছেদের মামলার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পরকীয়া। ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি দশটি তালাকের মধ্যে চারটির পেছনে রয়েছে অবৈধ সম্পর্কের অভিযোগ। পাশ্চাত্যে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। 

পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য বলছে, সেখানে শতকরা বিশ শতাংশের বেশি শিশু জন্ম নিচ্ছে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে। এর সামাজিক প্রভাব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহন করতে হচ্ছে। 

মনোবিজ্ঞানের গবেষণাও বলছে, অবৈধ সম্পর্ক দম্পতির মধ্যে বিশ্বাসের ভিত্তি ধ্বংস করে। যে সম্পর্ক একসময় ছিল নিরাপত্তা ও আস্থার জায়গা, সেখানে জন্ম নেয় সন্দেহ ও অবিশ্বাস। এ ধরনের পরিবেশ সবচেয়ে বেশি আঘাত করে শিশুদের মনে। 

জার্নাল অব ফ্যামিলি সাইকোলজি-র ২০২১ সালের গবেষণা প্রমাণ করেছে, এ ধরনের পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুরা স্কুলে মনোযোগ হারায়, মানসিক অস্থিরতায় ভোগে এবং ভবিষ্যতে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয়, আজকের তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীরা মোবাইল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সিনেমার প্রভাবে প্রেমের নামে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। 

কৈশোরের আবেগ, অপরিণত মানসিকতা এবং সামাজিক চাপে তারা এমন পথে যাচ্ছে, যেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ তারা পড়াশোনায় ব্যর্থ হচ্ছে, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে, এমনকি আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ পদক্ষেপ পর্যন্ত নিচ্ছে। 

রাসূলুল্লাহ সা.বলেছেন: “যখন একজন মানুষ জিনা করে, তখন ঈমান তার অন্তর থেকে সরে যায়।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। 

অর্থাৎ এটি কেবল সামাজিক অপরাধ নয়, বরং আধ্যাত্মিক মৃত্যুও বটে। অবৈধ সম্পর্ক মানুষকে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং অন্তরকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। 

অতএব স্পষ্ট হলো, অবৈধ সম্পর্ক হোক প্রেমের নামে, অবিবাহিতদের জিনা হোক বা বিবাহিতদের পরকীয়া—সবই ধ্বংসাত্মক। প্রেম বা সম্পর্ক যদি যৌন মিলন ছাড়া হয়, তবে সেটিও গুনাহ এবং বিচারকের বিবেচনায় তাআযীর শাস্তিযোগ্য। 

আর অবিবাহিতদের জিনা হলে তার শাস্তি একশত বেত্রাঘাত, আর বিবাহিতদের জিনা হলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ইসলামের এসব কঠোর বিধান আসলে সমাজকে রক্ষা করার জন্য প্রাচীরের মতো কাজ করে। 

পরকীয়া কোনো প্রেম নয়, বরং এটি এমন এক আগুন যা ধ্বংস করে দেয় বিশ্বাস, পরিবার, সন্তান, সমাজ ও সভ্যতা। ইসলাম যে কঠোর শাস্তির কথা বলেছে তা কেবল ভয়ের দেয়াল; প্রকৃত প্রতিরোধ নিহিত আছে আল্লাহভীতি, নৈতিক শিক্ষা, পারিবারিক বন্ধন এবং সামাজিক সচেতনতার মধ্যে। 

সত্যিকারের প্রেম হালাল সম্পর্কে, বিবাহের পবিত্র বন্ধনে। অবৈধ প্রেম কোনো ভালোবাসা নয়; এটি কেবল ক্ষত, বিষ এবং ধ্বংস। 

ইতিহাস আমাদের সতর্ক করেছে, বর্তমান আমাদের চোখের সামনে উদাহরণ সাজিয়ে দিয়েছে, আর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমাদের সিদ্ধান্তের জন্য। 

আমরা কি এই অগ্নি থেকে পরিবারকে রক্ষা করব, নাকি অবৈধ সম্পর্কের বিষ আমাদের সভ্যতাকে গ্রাস করবে—সেটিই আজকের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর

এই সম্পর্কিত আরো