লক্ষ্ণৌয়ের ব্যস্ত হযরতগঞ্জ বাজার থেকে সামান্য হাঁটা দূরত্বে খাণ্ডারি বাজারের সরু গলিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি তিনতলা হলুদ রঙের বাড়ি। কাঠের দরজার বাইরে লোহার গ্রিল। গত তিন দিন ধরে এই বাড়ির সামনেই ভিড় করে ছিল ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও পুলিশের সদস্যরা।
গত শুক্রবার থেকে এই বাড়ির বাইরে একজন নারী কনস্টেবলসহ দুজন পুলিশ সদস্য পাহারা দিচ্ছেন। সাদা পোশাকের এক কনস্টেবল বলেন, এই পরিবারের লোকেরা খুব কমই গেট খোলেন বা কারও সঙ্গে কথা বলার জন্য বাইরে আসেন।
এই বাড়িতেই থাকতেন শাহীন শহীদ আনসারী (৪৪) ও তাঁর ছোট ভাই পারভেজ আনসারী (৩৮)। গত সপ্তাহে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ কর্তৃক ফাঁস হওয়া কথিত ‘আন্তদেশীয় ও আন্তরাজ্য’ জঙ্গি মডিউলের (ট্রান্সন্যাশনাল ও ইন্টারস্টেট টেরর মডিউল) সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁদের আটক করা হয়েছে। আটকের পর শাহীনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে আর পারভেজকে আটক রাখা হয়েছে।
দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিনিধি দরজায় কড়া নাড়লে বেশ কয়েক মিনিট কেউ উত্তর দেয় না। অবশেষে তিন ভাই-বোনের মধ্যে বড় মোহাম্মদ শোয়েব (৪৮) গ্রিলের পেছন থেকে কথা বলতে রাজি হন।
শোয়েব জানান, তাঁদের বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী সৈয়দ আহমেদ (৮০) সন্তানদের চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার কখনো এসবে আগ্রহ ছিল না। তাই আমার বাবা শাহীন ও পারভেজের ওপর মনোযোগ দেন। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার জন্য তাদের কোচিংয়ে ভর্তি করান এবং শেষ পর্যন্ত তারা সফলও হয়। কিন্তু আমরা কখনো ভাবিনি যে, পরিস্থিতি এমন মোড় নিতে পারে।’
শোয়েব আরও বলেন, ‘কিছু ব্যক্তিগত মতপার্থক্যের কারণে আমি ২০২১ সাল থেকে তাদের (শাহীন ও পারভেজ) সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এর পর থেকে তারা বাড়িতে আসা বন্ধ করে দেয়। আমি অনেক দিন শাহীনের সঙ্গে কথা বলিনি, পুলিশ গ্রেপ্তার করার আগে সে কোথায় ছিল বা কী কাজ করছিল, তা আমি সত্যি জানতাম না।’
পরিবারের তথ্যমতে, শাহীন তাঁদের বাড়ির কাছেই লালবাগ গার্লস ইন্টার কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করেন আর পারভেজ ছিলেন ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজে।
এরপর শাহীন এলাহাবাদের এসআরএন মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ও এমডি সম্পন্ন করেন। তিনি ২০০৬ সালে ইউপিপিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে কানপুরের জিএসভিএম মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে ফার্মাকোলজির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তবে ২০১৩ সালে তিনি কাউকে না জানিয়ে ওই প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করেন এবং বারবার নোটিশের উত্তর না দেওয়ায় সে বছরই তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর তিনি ফরিদাবাদের আল-ফালাহ স্কুল অব মেডিকেল সায়েন্সেস অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে যোগ দেন।
অন্যদিকে, পারভেজ লক্ষ্ণৌয়ের এরা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং আগ্রার একটি কলেজ থেকে মেডিসিনে এমডি সম্পন্ন করেন। তিনি ২০২১ সালে ইন্টিগ্রাল ইউনিভার্সিটিতে সিনিয়র রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ দেন। এরপর ওই বছরের ৬ নভেম্বর পদত্যাগ করেন।
শোয়েব জানান, শাহীন ২০১৩-১৪ সালের দিকে প্রায় আড়াই বছর সৌদি আরবে ছিলেন। পারভেজও ২০১৬ সালে চাকরির জন্য মালদ্বীপ যান। এরপর দুজনই ২০১৭ সালের দিকে ভারতে ফিরে আসেন।
শোয়েব আরও জানান, দুজনেরই বিয়ে হয়েছিল। শাহীন ২০০৩ সালে চক্ষু সার্জন জাফর হায়াতকে বিয়ে করেন এবং তাঁদের দুটি ছেলে রয়েছে। কিন্তু ২০১৩ সালে বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে তাঁদের সম্পর্ক শেষ হয়। চিকিৎসক হায়াত এখন কানপুরের একটি সরকারি হাসপাতালে কর্মরত।
পারভেজ বিহারের এক নারীকে বিয়ে করেন এবং তাঁদের একটি মেয়ে রয়েছে। তবে শোয়েব জানান, তাঁর ছোট ভাই বিয়ের পরেই দূরে সরে যান এবং এখন আর তাঁদের সঙ্গে থাকেন না।
শোয়েব বলেন, ‘আমার মা ইয়াসমিন পারভীনের ডায়াবেটিস ছিল। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মা মারা যাওয়ার পর শাহীন বাড়িতে আসা আরও কমিয়ে দেয়।’
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, চলতি মাসে ফাঁস হওয়া জঙ্গি মডিউলের অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন শাহীন। অন্যরা হলেন রেড ফোর্টে গাড়ি বিস্ফোরণে জড়িত আল-ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওমর নবী, তাঁর সহকর্মী চিকিৎসক মুজাম্মিল আহমেদ এবং সাহারানপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্মী আদিল মজিদ। শাহীনও আল-ফালাহতে কাজ করতেন।
সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, শাহীন ‘হোয়াইট কালার অপরাধী’ গোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছিলেন। জইশ-ই-মোহাম্মদের সঙ্গে তাঁদের যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তিনি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একজন মুজাম্মিলকে তাঁর গাড়ি ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন, যা ফরিদাবাদ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, গত পাঁচ বছরে শাহীন তাঁর পরিবার থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন। পারভেজও ক্রমশ নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন।
পুলিশ ও অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াড (এটিএস) এখন এই পরিবারের দুই ভাই-বোনের জীবন, শিক্ষা, পরিচিত মানুষ, পারিবারিক সম্পর্ক এবং সৌদি আরব ও মালদ্বীপে অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে। পারভেজের ডিভাইসগুলোও তাঁর লক্ষ্ণৌয়ের বাড়ি থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
খাণ্ডারি বাজারের অনেকে এই পরিবারকে চেনেন, কিন্তু তাঁরা প্রকাশ্যে কিছু বলছিলেন না। একজন ফিসফিস করে ওই পরিবারের কথা বলেন। তাঁকে ওই বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করলে নাম না নিয়ে কেবল ইশারা করেন। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউই স্বীকার করতে চায় না যে তারা এই ভাই-বোনদের বা তাঁদের পরিবারকে চিনত। তাঁরা যখন ছোট ছিল, শুধু তখনকার কথাই মনে আছে। গত কয়েক বছরে দুই ভাই-বোন ধীরে ধীরে সবার থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে।