শিক্ষা ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই নতুন নীতিমালায় সরকারি কর্মকর্তাদের ওই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা ইতোমধ্যেই শিক্ষাঙ্গনসহ নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা ও প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। একদিকে যেমন অনেকেই এটিকে সময়োপযোগী, সাহসী ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন, অন্যদিকে কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাব্য জটিলতা নিয়েও কথা উঠছে। এই প্রতিবেদনে উভয় দিকের আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হলো।
ইতিবাচক সম্ভাবনা ও প্রয়োজনীয়তা
একটি বিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিচালনায় ম্যানেজিং কমিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দেশের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে—এই কমিটি কখনো কখনো রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত হয়ে পড়েছে। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত হয়েছে, শিক্ষকদের পেশাগত স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষা-অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
এমন বাস্তবতায়, ম্যানেজিং কমিটিতে সরকারি কর্মকর্তা অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত একপ্রকার গুণগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। সরকারি কর্মকর্তারা সাধারণত প্রশাসনিক দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত থাকেন। তাদের অন্তর্ভুক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও নীতিনির্ধারণে এক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। বিশেষ করে প্রধান শিক্ষকরা বহু ক্ষেত্রে যেভাবে আগের কমিটির অযৌক্তিক চাপে পড়ে পেশাগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন, এই নতুন কাঠামোতে সেই ঝুঁকি হ্রাস পাবে।
শিক্ষার্থীদের জন্য এটি আরও বড় উপকার বয়ে আনবে। রাজনৈতিক চাপমুক্ত, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও পরিকল্পিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের মানসিক ও একাডেমিক বিকাশে সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলে। একইসাথে, অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের নিরাপদ ও প্রগতিশীল শিক্ষা পরিবেশে দেখতে পাবেন, যা বিদ্যালয়ের প্রতি আস্থা বাড়াবে।
বাস্তবিক চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা
তবে এই উদ্যোগ নিখুঁত নয়। এর বাস্তবায়ন পর্যায়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা বিবেচনায় না আনলে ভালো উদ্যোগটি ব্যর্থ হতে পারে।
প্রথমত, অনেক সরকারি কর্মকর্তার ওপর এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব থাকে। বিদ্যালয় পরিচালনার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাঁরা যথাযথ সময় দিতে পারবেন কি না, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। যদি এটি কেবল কাগজে থাকে, বাস্তবে কোনো সক্রিয় অংশগ্রহণ না থাকে—তাহলে এর উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।
দ্বিতীয়ত, সরকারি কর্মকর্তারা অনেক সময় স্থানীয় প্রেক্ষাপট, অভিভাবকদের মানসিকতা বা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বাস্তব সমস্যা সম্পর্কে অবগত নাও থাকতে পারেন। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই অজ্ঞতা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সেক্ষেত্রে স্থানীয় অভিভাবক প্রতিনিধি ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া জরুরি।
তৃতীয়ত, কিছু প্রতিষ্ঠান পূর্বে যেভাবে রাজনৈতিক প্রভাবাধীন কমিটির দ্বারা পরিচালিত হতো, সেখানে নতুন পরিবর্তন গ্রহণে প্রতিরোধ আসতে পারে। আগের কমিটির লোকজন নানা রকম অপপ্রচার বা প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি করতে পারে। সেসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় দৃঢ় প্রশাসনিক মনোভাব ও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দরকার।
চতুর্থত, একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা হলো—সব সরকারি কর্মকর্তাই যে এই দায়িত্বকে পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করবেন, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে, কেউ কেউ এই ক্ষমতা ব্যবহার করে বিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর অযাচিত চাপ সৃষ্টি করছেন, শিক্ষক বা প্রধান শিক্ষককে অহেতুক হয়রানি করছেন অথবা অর্থনৈতিক লেনদেনে অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন। এই ধরণের অপপ্রয়োগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শান্ত পরিবেশ বিঘ্নিত করতে পারে, শিক্ষক-প্রশাসনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে পারে। এই জন্য একটি শক্তিশালী জবাবদিহিতার কাঠামো থাকা অত্যন্ত জরুরি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনের মূল্যায়ন, অভিযোগ দায়েরের নিরপেক্ষ ব্যবস্থা এবং দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে শাস্তি কার্যকর করার মতো কার্যকর ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।
করণীয় ও সুপারিশ
এই উদ্যোগকে সফল করতে হলে প্রথমেই দরকার, কর্মকর্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করা। স্কুল ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তা যেন ন্যূনতম একাডেমিক ও শিক্ষাগত বিষয়ে প্রশিক্ষণ বা ওরিয়েন্টেশন পান—এটা জরুরি।
পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে, ম্যানেজিং কমিটিতে অভিভাবক প্রতিনিধি, অভিজ্ঞ শিক্ষক প্রতিনিধি ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধির অংশগ্রহণ রক্ষায় একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। এটি কমিটিকে আরও গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক করে তুলবে।
যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পূর্বে অনিয়মের শিকার হয়েছে, সেখানে আলাদাভাবে তদারকি বাড়ানো উচিত। কোনো প্রতিষ্ঠান যেন রাজনৈতিক প্রতিশোধ বা পুরনো বিরোধের বশবর্তী হয়ে নতুন সিদ্ধান্তের অপব্যবহার না করে—সে নিশ্চয়তা দিতে হবে।
সবশেষে, জাতীয় পর্যায়ে এই সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা পর্যালোচনার জন্য একটি পর্যালোচনা বোর্ড বা কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যারা সময়কালভিত্তিক প্রতিবেদন তৈরি করবে এবং প্রয়োজনে নীতিমালায় সংশোধন আনবে।
সরকারি কর্মকর্তাদের ম্যানেজিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত শিক্ষার গুণগত উন্নয়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি শিক্ষকদের নিরাপত্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আনার আশ্বাস দেয়। তবে এর চূড়ান্ত সফলতা নির্ভর করবে সংশ্লিষ্টদের পেশাদারিত্ব, মানবিকতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার আন্তরিক প্রচেষ্টার ওপর।
এই সিদ্ধান্ত যদি সুচিন্তিতভাবে ও দায়িত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে তা হতে পারে একটি টার্নিং পয়েন্ট—যা বাংলাদেশের বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও গতিশীল, আধুনিক ও জনবান্ধব করে তুলবে।