শিক্ষা মানবিক উন্নয়নের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। তবে এই শিক্ষা যদি বৈষম্যমুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও লিঙ্গসংবেদনশীল না হয়, তবে তা সমাজের বৃহত্তর অংশের সম্ভাবনা ব্যাহত করে। বাংলাদেশে লিঙ্গভিত্তিক অসমতা ও সমাজের প্রান্তিক গোষ্ঠীর শিক্ষাবঞ্চনা দীর্ঘদিনের বাস্তবতা। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (IER) আয়োজন করেছিলো“Gender and Inclusive Pedagogies” বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি যা শিক্ষার মৌল কাঠামোতে পরিবর্তন আনার সম্ভাব।
আমি নিজে এই প্রশিক্ষণে দীর্ঘদিন অংশগ্রহণ করে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদানের রীতি ও পদ্ধতিতে গভীর পরিবর্তন এনেছি। নিবন্ধটি সেই বাস্তব অভিজ্ঞতা, সমকালীন গবেষণা এবং বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে লিঙ্গ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাদর্শের তাৎপর্য নিয়ে রচিত।
লিঙ্গ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাদর্শ: ধারণাগত বিশ্লেষণ
Gender-sensitive pedagogy বলতে বোঝায় এমন এক শিক্ষণপদ্ধতি যা ছাত্র-ছাত্রী উভয়ের অভিজ্ঞতা, প্রয়োজন ও বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে শিক্ষার পরিবেশ ও উপকরণ তৈরি করে। এটি সমাজে প্রচলিত লিঙ্গভিত্তিক ধারণা ও প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও সম্মানবোধ গড়ে তোলে।
অন্যদিকে, Inclusive pedagogy এমন একটি শিক্ষাদর্শ যা ভৌগোলিক, ভাষাগত, আর্থসামাজিক, শারীরিক ও মানসিক ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষে সক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত করে। বিশ্বব্যাংক, UNESCO এবং UNICEF এর গবেষণায় দেখা গেছে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ, উপস্থিতি ও শিক্ষালাভ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায় (UNESCO, 2020)।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে এখনও অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের সময় লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিভিন্ন রূপ দেখা যায়—যেমন: ছেলেদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া, মেয়েদের চুপ থাকতে উৎসাহিত করা, বা প্রান্তিক গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের উপেক্ষা করা। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের স্কুল ত্যাগের হার ছেলেদের তুলনায় বেশি, যার পেছনে সামাজিক কুসংস্কার, বাল্যবিবাহ ও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা অন্যতম কারণ (BANBEIS, 2022)।
অন্যদিকে, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সন্তান কিংবা শ্রমজীবী পরিবারের শিশুরাও শিক্ষার মূলধারায় অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয় শুধুমাত্র পাঠদান পদ্ধতির সীমাবদ্ধতার কারণে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশল ও মনোভাব পরিবর্তন করা জরুরি, যা সম্ভব অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও লিঙ্গসংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের মাধ্যমে।
প্রশিক্ষণে আমার অর্জন
IER-এর প্রশিক্ষণে আমি যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে শিখেছি, তা হলো:
লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ভাষা ও আচরণ প্রয়োগের কৌশল
বিভিন্ন সক্ষমতা সম্পন্ন শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
ক্লাসরুমে সহানুভূতিশীল ও সহযোগিতামূলক পরিবেশ গড়ে তোলা
আন্তঃব্যক্তিক পার্থক্যকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা
প্রশিক্ষণের পর, আমি আমার বিদ্যালয়ের পাঠদান পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছি। উদাহরণস্বরূপ, পূর্বে যেখানে মেয়েরা প্রশ্ন করতে সংকোচ বোধ করত, সেখানে এখন তারা দলনেতা হিসেবে কাজ করছে। ছেলেরা সহনশীল হয়ে উঠছে, আর দলগত কাজের মাধ্যমে সকলে একে অপরকে শ্রদ্ধা করতে শিখছে। এই পরিবর্তনের পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক ও লিঙ্গসংবেদনশীল শিক্ষাদর্শ।
গবেষণা ফলাফলের সাথে বাস্তব অভিজ্ঞতার মিল
IER ও UNESCO এর এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, যেখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাদর্শ অনুসরণ করা হয়, সেখানে:
শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার ১৮% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়
মেয়েশিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলাফলে গড় GPA ০.৪ পয়েন্ট পর্যন্ত উন্নতি ঘটে
শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস ও শ্রেণিকক্ষের শৃঙ্খলা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়
আমার বিদ্যালয়ের বাস্তব অভিজ্ঞতাও এই তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ছয় মাসের মধ্যে উপস্থিতির হার বেড়েছে, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে, এবং বার্ষিক পরীক্ষায় ফলাফলে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।
নীতিনির্ধারণ ও আগামীর করণীয়
সরকারের শিক্ষা নীতিমালায় লিঙ্গ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও তা বাস্তবায়নে এখনও অনেক ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই বিষয়গুলোকে বাধ্যতামূলক করা উচিত। একই সঙ্গে, প্রত্যেক
বিদ্যালয়ে অন্তত একজন “Inclusivity and Gender Champion Teacher” নিয়োগ বা মনোনয়ন দেওয়া যেতে পারে, যারা শ্রেণিকক্ষ এবং বিদ্যালয় পর্যায়ে এই দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখবেন।
শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার, স্থানীয় সম্পদের একীভূতকরণ, এবং অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার পথকে আরও সুগম করতে পারে।
উপসংহার
শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মানুষকে সচেতন, আত্মনির্ভরশীল ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে সক্ষম করে তোলা। এই লক্ষ্য অর্জনের পথ লিঙ্গ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাদর্শ ছাড়া অসম্পূর্ণ। IER-এর প্রশিক্ষণ আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক পরিবর্তন এনেছে এবং শ্রেণিকক্ষে তার বাস্তব প্রয়োগে শিক্ষার্থীদের আচরণ, অংশগ্রহণ ও ফলাফলে দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটেছে।
আমাদের প্রত্যেক শিক্ষক, নীতিনির্ধারক ও শিক্ষাকর্মীকে এ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। তবেই আমরা একটি বৈচিত্র্যবহুল, ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হতে পারবো, যা জাতি হিসেবে আমাদের টেকসই উন্নয়ন ও ন্যায়ের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
লেখক:
সাখাওয়াত হোসেন
সহকারী শিক্ষক
সৈয়দ কুতুব জালাল মডেল হাইস্কুল