নাসির উদ্দীন আহমদ মিঠু, মৌলভীবাজার-১ আসনের বিএনপি মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী। বড়লেখা ও জুড়ির রাজনীতির অঙ্গনে দীর্ঘদিনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অত্যন্ত ভদ্র ও অমায়িক এই ব্যক্তিত্ব গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সংগঠনকে সুসংগঠিত করা, নেতৃত্বকে ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং কঠিন সময়েও দলের পাশে দৃঢ়ভাবে থাকার এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। ২০১৮ সালের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলের হয়ে নির্বাচন করে স্বল্প সময়ে ষাট হাজারের বেশি ভোট অর্জন ছিল তার গ্রহণযোগ্যতার স্পষ্ট প্রতিফলন। আমি সেবার প্রথম ভোটার ছিলাম, এবং জীবনের প্রথম ভোটটি দিয়েছিলাম তাকেই—একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিকে।
২০২৪ সালের আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি কারাবরণ করে নিজের নেতৃত্বের নৈতিক অবস্থানকে সুস্পষ্ট করে তুলেছেন। তাই আসন্ন নির্বাচনে দল তাকে মনোনয়ন দিয়ে যে মূল্যায়ন করেছে, তা ন্যায্য। কিন্তু শুধু মনোনয়ন পাওয়া যথেষ্ট নয়, সেই সম্মানটিকে ধরে রাখাও এখন তার অন্যতম দায়িত্ব।
মিঠু বনেদি পরিবারের সন্তান; অঢেল ধনসম্পদের মালিক। ব্যক্তিগতভাবে তার অর্থনৈতিক প্রয়োজন নেই—এটি জনগণের জন্য এক ধরনের স্বস্তির খবর। কিন্তু তার আশেপাশের কিছু সুবিধাবাদী মানুষের কারণে তার ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া খুব স্বাভাবিক, যা তাকে সাবধানতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।
'চার খলিফা'র বেড়াজাল এবং জনগণের প্রত্যাশা:
বড়লেখা ও জুড়ির রাজনীতির মাঠে বহুদিন ধরেই একটি প্রচলিত কথা শোনা যায়—“চার খলিফা ছাড়া মিঠু চলেন না!” এই চারজন সবসময় তাকে আষ্টেপৃষ্টে থাকে। নতুন করে সেই নামগুলো বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না; নামগুলো বড়লেখা ও জুড়ির মানুষ জানে। কিন্তু ভোটের মাঠে এই চারজনই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই তাকে অবশ্যই এই চক্রের বাইরে এসে জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে। মানুষ চায় একজন সহজ-সরল, মানুষের দুঃখ-কষ্ট বোঝে এমন একজন ব্যক্তিকে। যিনি কোনো নেতা নন, এমপি সাহেব নন; একজন পরামর্শদাতা, একজন অভিভাবক হিসাবে তাদের সুখে দুঃখে পাশে থাকবেন।
উন্নয়নবঞ্চিত জনপদ ও লুটেরাদের চিত্র:
জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসন হলো মৌলভীবাজার–১। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই আসনে রয়েছে অসংখ্য চা–বাগান, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, হাকালুকি হাওর এবং ছোট-বড় অনেক পাহাড় ও টিলা। অথচ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এসব পাহাড়–টিলা নির্বিচারে ধ্বংস করা হয়েছে। রাতের আঁধারে পাতারিয়া পাহাড়ের সেগুন গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। হাকালুকি হাওর, যা জনগণের সম্পদ, তা ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা একেএম হেলাল, মেয়র কামরান চৌধুরীসহ অনেকেই। পাহাড় ধ্বংসের নেপথ্যের নায়ক ছিলেন তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান সুয়েব, ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিনরা। এছাড়া পাতিনেতারা তো ছিলেনই ছোটবড় লুটপাটে।
এছাড়া, বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের বোবারতল এলাকাকে ইচ্ছাকৃতভাবে উন্নয়নবঞ্চিত রাখা হয়েছিল। জরাজীর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানির অভাব ও স্যানিটেশন সংকটে এখানকার মানুষ এখনও মানবেতর জীবন যাপন করছে। একবিংশ শতাব্দীতেও তারা মৌলিক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত।
অতএব, এসব এলাকার মানুষের কাছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পৌঁছানো উচিত নাসির উদ্দীন মিঠুর। মানুষের কষ্টে শরিক হয়ে, গায়ে কাদাজল মেখে তাদের পাশে দাঁড়ানই হবে সত্যিকারের জনপ্রতিনিধির কাজ — তাহলেই সত্যিকারের জনতার নেতা হয়ে উঠা সম্ভব হবে। রাজনীতিতে ন্যারেটিভ তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মিঠুর প্রতি অনুরোধ আপনার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ যে ন্যারেটিভ তৈরি করতে চাইছে, সেটি পরিপক্ব হওয়ার আগেই ভেঙে দিন।
জনতার আস্থা অর্জনে করণীয়:
বড়লেখায় আপনার একটি ইতিবাচক ইমেজ তৈরি হয়েছে। সেই ইমেজ অক্ষুণ্ণ রাখুন। জনগণ জানে আপনি একজন সচ্ছল ব্যক্তি; তাদের টাকায় আপনার প্রয়োজন নেই। তাই দায়িত্ব পেলে জনগণের স্বার্থে কাজ করুন, প্রয়োজনে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে সহযোগিতা দিন। জনগণের সামনে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করুন যেন তারা বিশ্বাস করে— আপনি রাজনীতিতে এসেছেন জনসেবার জন্য, ব্যক্তিস্বার্থে নয়।
হাকালুকি হাওর দখল নয়, বরং রক্ষার উদ্যোগ নিন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি জনসেবা তহবিল গঠন করুন। চার খলিফার বাইরেও এমন কিছু বিশ্বস্ত ও দক্ষ মানুষ তৈরি করুন যাদের ওপর আপনি আস্থা রাখতে পারেন।
উত্তর শাহবাজপুর থেকে দক্ষিণভাগ ইউনিয়ন, কিংবা জুড়ির জায়ফরনগর থেকে ফুলতলা ইউনিয়ন— প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে বিশেষায়িত টিম গঠন করুন। এসব টিমের দায়িত্ব হবে এলাকার সমস্যা ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করা। অবশ্যই এ কাজটি করবেন যারা এলাকার বাস্তব অভিজ্ঞতা রাখেন তাদের মাধ্যমে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে জনগণের সাথে সরাসরি কথা বলুন, সমস্যার সমাধান পরিকল্পনা উপস্থাপন করুন এবং তাদের মতামত নিন। দেখবেন, মানুষ আপনাকে নিজেদের আপনজন হিসেবে গ্রহণ করছে।
বড়লেখায় সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমি দেখেছি, এই এলাকার মানুষ অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ও আন্তরিক। আপনি যদি তাদের কাছে যান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখান, তাহলে তারাও আপনাকে তেমনি সম্মান ও ভালোবাসা দেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সক্রিয়ভাবে মানুষের কথা শোনা (active listening) রাজনৈতিক নেতার প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস প্রায় ৬০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। তাই জনগণের কাছে যান, তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন, প্রয়োজনে নোট নিন বা রেকর্ড করুন— যাতে তারা বুঝতে পারে আপনি তাদের কথা গুরুত্ব দিচ্ছেন। মানুষ যখন বুঝবে তাদের কথা আপনি সত্যিই শুনছেন, তখন তারা আপনাকে নিয়ে ইতিবাচক বার্তা ছড়াবে।
সবশেষে, সাধারণ মানুষ তাদের নেতার মধ্যে নম্রতা, শালীনতা ও সহমর্মিতা দেখতে চায়। আপনি একজন শিক্ষিত, ভদ্র ও বিচক্ষণ ব্যক্তি— এই গুণগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারলে নিশ্চয়ই তারা আপনাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করবে।
সুস্পষ্ট ভিশন ও রোডম্যাপের গুরুত্ব:
তবে রাজনীতিতে গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জনগণ আপনাকে ভোট দিলে তারা কি পাবে সেটি পরিষ্কার করা সবচেয়ে জরুরি। এজন্য আমি আগেই বলেছি আপনার পরিকল্পনা জনগণের সামনে হাজির করতে হবে। বড়লেখার উন্নয়ন নিয়ে আপনার হাতে থাকতে হবে সুস্পষ্ট, বাস্তবসম্মত ও দূরদর্শী পরিকল্পনা। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত—যা আন্তর্জাতিক পর্যটন সম্ভাবনাময় একটি স্থান—তার সার্বিক উন্নয়নে অবকাঠামো, স্যানিটেশন, নিরাপত্তা, পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। হাকালুকি হাওর—দেশের বৃহত্তম হাওরগুলোর একটি, যা পরিবেশগত সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার—তার সংরক্ষণ, পরিবেশবান্ধব পর্যটন, জেলে সম্প্রদায়ের উন্নয়ন ও নিয়মিত ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন রয়েছে। বোবারতল—বড় সম্ভাবনাময় একটি পর্যটন ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র—এটির উন্নয়ন পরিকল্পনাও আপনার হাতে থাকতে হবে। এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া দুই উপজেলার গ্রামীণ জনপদের রাস্তা, সেতু, কালভার্ট এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন আর্থসামাজিক উন্নয়নের ভিত্তি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সমস্যা—যেমন চিকিৎসা, শিক্ষা, কৃষি, বাজার ব্যবস্থাপনা—এসবের জন্যও দরকার সুসংগঠিত পরিকল্পনা। এছাড়া এখানকার চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে আপনাকে কাজ করতে হবে। যেহেতু আপনি নিজে চা বাগানের মালিক সেহেতু বাগানের শ্রমিকদের প্রতি আলাদা টান আপনার কাজ করবে বলে প্রত্যাশা।
একজন সম্ভাব্য জননেতা হিসেবে মিঠুর উচিত বড়লেখা ও জুড়ির জন্য নিজের স্বতন্ত্র ভিশন ও রোডম্যাপ প্রস্তুত করা। উন্নয়ন পরিকল্পনা শুধু কাগজে-কলমে নয়—বাস্তবায়নযোগ্য, সময়সীমাবদ্ধ এবং জনগণের মতামতভিত্তিক হতে হবে।
দলীয় কাঠামো মজবুত করা ও ঐক্যের আহ্বান:
এছাড়া তাকে শক্ত করতে হবে দলীয় কাঠামো। শুধু "চার খলিফা" নিয়ে চললে হবে না। স্থানীয় নেতাদের কাছে টানতে হবে, তাদের মতামতকে মূল্য দিতে হবে, রুট পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কথা শুনতে হবে। দলের অভিমানী নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে কাছে নিয়ে আসতে হবে। তাদের সঙ্গে প্রতিটি বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
বড়লেখার বিএনপির রাজনীতিতে এখন নানা ধরনের জটিলতা, মতপার্থক্য ও দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এসব সমাধানে তাকে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে হবে। দলকে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও সমন্বিত করে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। বিএনপির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন শরিফুল হক সাজু। দল ও জনগণের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। বিশেষ করে তরুণদের একটা অংশ তাকে পছন্দ করে। সাজুর সাথে রাজনৈতিক বিরোধ থাকলে মিটিয়ে ফেলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ভোটের মাঠে সাজু একটা বড় ফ্যাক্টর। এছাড়া বড়লেখার রাজনীতিতে মহিবুর রহমান ফারুক, মেয়র ফখরুল ইসলাম, মুজিব রাজা চৌধুরী, জালাল আহমদ তালাল কিংবা আলাল উদ্দিনরা এক একটা ফ্যাক্টর।
রাজনীতির মাঠে তাদের সাথে বিরোধ থাকতেই পারে তবে দিনশেষে একই দল ও প্রতীকের স্বার্থে তাদেরকেও কাছে টানতে হবে। আপনার কাছের অনেকেরই অপছন্দের তালিকায় তারা। তারাই হয়তো আপনাকে ভুল বুঝাচ্ছে। তবে ভোটের মাঠে এরা ফ্যাক্টর। আপাত দৃষ্টিতে এদের সংখ্যা ৫% মনে হলেও ভোটের সংখ্যায় কনভার্ট করলে এটি ১৫ থেকে ২০% ছাড়িয়ে যেতে পারে। ভোটের মাঠে তারা সাইলেন্ট থাকা মানে ২০% ভোটার সাইলেন্ট যেটা আপনার বিপক্ষে শিবিরকে ফায়দা পাইয়ে দেবে। এবং এটিই আপনার পরাজয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই সবার সাথে কথা বলুন, বিরোধ মিটিয়ে ফেলুন এটাই হবে রাজনীতির জয়।
জনগণ আপনার ওপর আস্থা রেখেছে। সেই আস্থা রক্ষা করতে হলে আপনাকে মানুষের দোরগোড়ায় যেতে হবে—চোখের কালো চশমা খুলে, প্রান্তিক মানুষের ভাষা বুঝে, তাদের সুখ-দুঃখে পাশে থেকে।
আমার পরিচিত একজন ইউপি সদস্য আছেন যাকে সাধারণত এলাকার লোকজন তেমন একটা পছন্দ করেন না; ভোটের আগে মানুষ বলে, তাকে ভোট দিবেন না। তবু তিনি বারবার নির্বাচিত হন। কারণ তিনি ভোটের সময় সরাসরি মানুষের কাছে এসে তাদের মন জয় করার কৌশল জানেন — দরকার হলে নমনীয়তা দেখান, পায়ে পড়েন। বিপক্ষেরও কাছে নিজের অবস্থান উন্মুক্ত রাখেন। ফলে প্রথমে যে বিরোধ থাকে, সেটাই দ্রুত অপসৃত হয় এবং মানুষ মনে করে তার জন্য ইতিবাচক ভাবনা উদ্ভূত হয়েছে। দূর থেকে সে যেন চিরশত্রু হলেও, নিজের মুখে বা আচরণে তিনি মানুষকে তাৎক্ষণিকভাবে নিজের করে নিতে পারেন। কথার ক্ষমতাই তার প্রধান শক্তি; রাজনীতিতে এটাই সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র।
তাই পরিশেষে নিজেকে জনগণের কাছে বিলিয়ে দিন।
আপনি যদি সত্যিকার অর্থে মানুষের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারেন, দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন, বড়লেখার উন্নয়নের জন্য সুস্পষ্ট ভিশন নিয়ে এগিয়ে আসেন—তাহলে জনগণই আপনাকে সংসদে পাঠাবে। কোনো চার খলিফা নয়।
লেখক: আশফাক জুনেদ, যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক